ইউরিক অ্যাসিড কী
শরীরের ভেতর কার্যকারিতা ঠিক রাখবার জন্য স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী নানান রকম বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয়। এমনি এক বর্জ্য হল ইউরিক অ্যাসিড। শরীর যখন পিউরিনকে ভাঙে, তখনই তৈরি হয় এই অ্যাসিড। রক্তে কিছু পরিমাণে ইউরিক অ্যাসিড থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন এই অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়, তখনই শুরু হয় নানান রকম শারীরিক সমস্যা। যেমন গাউট, কিডনিতে পাথর, এমনকি আরও অনেক জটিল অসুখও দেখা দিতে পারে।
ইউরিক অ্যাসিড বাড়ার লক্ষণ
ইউরিক অ্যাসিড যখন বেড়ে যায়, তখন শরীর নানান রকম সংকেত দিতে শুরু করে।
- জয়েন্টে ব্যথা: হঠাৎ করেই যদি জয়েন্টে, বিশেষ করে বুড়ো আঙুলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, তাহলে সাবধান! এটা গাউটের লক্ষণ হতে পারে।
- ফোলা এবং লাল হয়ে যাওয়া: যে জয়েন্টে ব্যথা হয়, সেই জয়েন্ট ফুলে যেতে পারে, লাল হয়ে যেতে পারে, এমনকি ছুঁয়ে দেখলেও ব্যথা লাগতে পারে।
- জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া: বিশেষ করে অনেকক্ষণ বসে থাকলে বা শুয়ে থাকলে যদি আপনার জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়, তাহলে এটা ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ হতে পারে।
- কিডনিতে পাথর: বেশি ইউরিক অ্যাসিড কিডনির ভেতর পাথর তৈরি করে। এর ফলে পেটে অথবা পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে।
- ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া: যদি ঘন ঘন প্রস্রাব পায়, বিশেষ করে রাতের বেলা, তাহলে এটাও ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ হতে পারে।
- ক্লান্তি: যদি সব সময় ক্লান্ত এবং অবসন্ন বোধ করেন, কোনো কারণ ছাড়াই, তাহলে এটাও বেশি ইউরিক অ্যাসিডের লক্ষণ হতে পারে।
ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে কী কী ক্ষতি হতে পারে
বেশি ইউরিক অ্যাসিড শুধু একটা সমস্যা নয়, এটা অনেক বড় বড় অসুখের দরজা খুলে দিতে পারে।
- গাউট: এটা এক ধরনের বাত রোগ, যেখানে জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা এবং ফোলা হয়। বেশি ইউরিক অ্যাসিড এই রোগের একটা প্রধান কারণ।
- কিডনির সমস্যা: যখন রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকে, তখন কিডনিতে পাথর জমতে শুরু করে। এর ফলে কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়, এমনকি কিডনি ফেলও করতে পারে।
- হৃদরোগ: গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ইউরিক অ্যাসিড বেশি, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকিও বেশি।
- মেটাবলিক সিনড্রোম: এই রোগে একসাথে অনেকগুলো সমস্যা দেখা দেয়, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ রক্তে শর্করা, কোলেস্টেরলের সমস্যা। ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকলে, এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
ইউরিক অ্যাসিড কমাতে সাহায্যকারী খাবার
আমাদের পরিচিত এমন অনেক খাবার আছে, যা নিয়মিত খেলে ইউরিক অ্যাসিডকে দূরে রাখা সম্ভব।
- গ্রিন টি: গ্রিন টি যে শুধু মন ভালো রাখে তা নয়, শরীরও ভালো রাখে। গ্রিন টি নিয়মিত পান করলে, ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমে। শুধু তাই নয়, কিডনির কার্যক্ষমতাও বাড়ে।
- শসা: গরমকালে শসা খেতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি ইউরিক অ্যাসিড কমাতেও এর জুড়ি নেই। শসায় প্রচুর পরিমাণে জল থাকে, যা ইউরিক অ্যাসিডকে পাতলা করে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়।
- সজনে ডাঁটা: সজনে ডাঁটার বীজ ইউরিক অ্যাসিড কমাতে বেশ কার্যকরী। এমনকি, গাউটের যন্ত্রণা কমাতেও সাহায্য করে।
- গাজর ও টমেটো: গাজর এবং টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এছাড়া, এগুলো ক্ষারধর্মী, তাই শরীরের অতিরিক্ত অ্যাসিডিটি কমাতে সাহায্য করে, ফলে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রাও কমে।
- আপেল: আপেলে ম্যালিক অ্যাসিড নামে এক ধরনের উপাদান থাকে, যা ইউরিক অ্যাসিডকে নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিন একটা আপেল খাওয়ার অভ্যাস করুন।
- লো-ফ্যাট দুগ্ধজাত খাবার: লো-ফ্যাট দুধ, দই, পনির, এই খাবারগুলোতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে, কিন্তু পিউরিন কম থাকে। তাই এগুলো ইউরিক অ্যাসিড কমাতে বেশ সাহায্য করে।
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: ওটস, গোটা শস্য, এবং নানা রকম সবজি, যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, সেগুলো ইউরিক অ্যাসিড শুষে নিয়ে হজমের পথ দিয়ে বের করে দিতে সাহায্য করে।
- চেরি: এই ছোট্ট লাল ফল দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি গুণেও ভরপুর। চেরিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। প্রদাহ কমলে, ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- বেরি: স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, রাস্পবেরি – এই বেরি জাতীয় ফলগুলো খেতে যেমন মজাদার, তেমনি স্বাস্থ্যের জন্যও খুব উপকারী। এগুলোতে পিউরিন নামক এক ধরনের উপাদান খুবই কম থাকে, যা ইউরিক অ্যাসিড তৈরিতে ভূমিকা রাখে। আবার এগুলোতে ভিটামিন সি প্রচুর পরিমাণে থাকে, যা ইউরিক অ্যাসিড কমাতে সাহায্য করে।
- জল : জল কোনো খাবার না হলেও, ইউরিক অ্যাসিড কমাতে এর ভূমিকা অপরিসীম। প্রচুর পরিমাণে জল পান করলে, কিডনি সঠিকভাবে কাজ করে এবং ইউরিক অ্যাসিড প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যায়।
সুস্থ থাকতে হলে ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি। নইলে গাউট, কিডনিতে পাথর, এমনকি হৃদরোগের মতো মারাত্মক অসুখও হতে পারে। তাই সঠিক খাবার খাওয়া, প্রচুর জল পান করা, আর শরীরের লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া খুবই জরুরি।