ভ্যালি অফ কিংস – এই বিস্তৃত মরুপ্রান্তর বহু প্রাচীন রাজাদের চিরনিদ্রার সাক্ষী। লুকিয়ে আছে অজানা রহস্য, ধনরত্ন, আর সময়ের সাথে মিশে যাওয়া ইতিহাস। আর এই বিশাল নেক্রোপলিসের বুকে হাজার বছর ধরে নিজের অস্তিত্ব লুকিয়ে রেখেছিলেন এক কিশোর ফারাও তুতানখামুন – যার বংশপরিচয় আজও রহস্যের আবরণে ঘেরা। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার যখন তুতানখামুনের সমাধি আবিষ্কার করেন, তা প্রত্নতত্ত্বের জগতে বিরাট আলোড়ন তোলে। মিশরের ইতিহাস, তাদের রিচুয়ালস ও অসাধারণ কারুশিল্প- সবকিছুই তুতানখামুনের সমাধির মধ্য দিয়ে যেন নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।
প্রাচীন মিশরের বহু সমাধিই ইতিহাসের নানা সময়ে লুণ্ঠিত হয়েছে, বহু অমূল্য সম্পদ হারিয়ে গেছে চিরতরে। কিন্তু তুতানখামুনের সমাধি ছিল আলাদা। প্রায় ৩০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লুকিয়ে থেকে, চোর-ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে, নিজের অমূল্য ধনরত্নের সঙ্গে সময়ের অতলে হারিয়ে যাচ্ছিলেন এই কিশোর রাজা।
হাওয়ার্ড কার্টার ও তার দল যখন প্রথম সমাধির মুখ খোলেন, যান স্বপ্নের চেয়েও চমকপ্রদ দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান । সমাধির প্রথম কক্ষটিই অপরূপ সব জিনিসপত্রে ভর্তি ছিল; সেগুলি ফারাওয়ের মৃত্যুর পর পরবর্তী জীবনের সঙ্গী হওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এ তো ছিল শুরু মাত্র! তারপর যত ভেতরে এগোলেন, ধনরত্নের ভাণ্ডার – সোনার গয়না, রথ, এমনকি তুতানখামুনের বিখ্যাত সোনার মুখোশ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হলো। সবকিছুর নিখুঁত কারুকার্য আর অপরূপ সৌন্দর্য প্রাচীন মিশরের চরম শিল্পোৎকর্ষের নিদর্শন।
তুতানখামুনের সমাধির সম্পদ শুধু রাজার জীবনযাত্রাই তুলে ধরে না, প্রাচীন মিশরের বিশ্বাস, শিল্পকলা ও দৈনন্দিন প্রথা সম্পর্কে আমাদের জানার দিগন্ত প্রসারিত করে। মৃত ফারাওয়ের সোনার মুখোশ, তার নিশ্চিহ্ন মুখচ্ছবি ও ল্যাপিস লাজুলি পাথরের নিখুঁত খোদাইকাজ মিশরীয়দের মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণার প্রতিফলন ঘটায়। এছাড়াও সমাধিতে প্রচুর অলঙ্কার – তাবিজ, আংটি, ব্রেসলেট সবই মূল্যবান পাথর ও সোনায় তৈরি। এগুলোর গায়ে উৎকীর্ণ বিভিন্ন চিহ্ন, দেবতাদের প্রতীক – সবেরই উদ্দেশ্য ফারাওকে পরবর্তী জীবনের যাত্রায় সুরক্ষিত রাখা।
সমাধিতে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র – রথ, অস্ত্র, এমনকি তুতানখামুনের সিংহাসন পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এগুলি ফারাওয়ের পৃথিবীর জীবন ও মর্যাদাকে চোখের সামনে তুলে ধরে। আর দেওয়ালজুড়ে অসাধারণ চিত্রকর্মে তুতানখামুনের ঐশ্বরিক জন্ম ও পরবর্তী জীবনে দেবতাদের দ্বারা গৃহীত হওয়ার দৃশ্য প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মবিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি সম্পর্কে গভীর ধারণা দেয়।
তুতানখামুনের সমাধি শুধু ধনরত্নের উৎস নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমীমাংসিত রহস্য। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই এই কিশোর ফারাওয়ের অকালমৃত্যু নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বহু তত্ত্ব প্রচলিত আছে, কেউ অসুস্থতার কথা বলেন, আবার কারও মতে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন তিনি। তার ছোট ও অতটা জাঁকজমকহীন সমাধিক্ষেত্রটিও ইঙ্গিত দেয় যে তুতানখামুনকে সম্ভবত তাড়াহুড়ো করে সেখানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, যেটা এই
রাজার মর্যাদার যথাযথ প্রতিফলন ঘটায় না। এর থেকে কিছু গবেষক মনে করেন, এই সমাধিক্ষেত্র তুতানখামুনের জন্য নির্মিত হয়নি। এর পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের হাতও থাকতে পারে – এই সবই আজও গবেষণার বিষয়।
মিশরের ইতিহাসের এক অশান্ত সময়ে তুতানখামুন সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার আগে ফারাও আখেনাতেন ধর্ম নিয়ে যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন, তারই রেশ ধরে চলছিল তখন। তুতানখামুন তার রাজত্বকালে প্রথাগত মিশরীয় ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন এবং রাজধানী আখেতাতেন থেকে থিবসে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পদক্ষেপের চেয়েও, তার মৃত্যুর কারণ, সমাধির ধনরত্ন, আর সেগুলোকে ঘিরে থাকা কিংবদন্তিই পৃথিবীকে বেশি আকর্ষণ করে।
এই সবের মাঝে একটি অদ্ভুত গল্প যুগ যুগ ধরে প্রচলিত আছে – এই সমাধি আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই কিংবদন্তি আজও তুতানখামুনের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।
ফারাওয়ের অভিশাপ এক মিথ, যেখানে বলা হয় প্রাচীন মিশরীয়দের শান্তিতে বিরাজ করতে না দিলে অশুভ শক্তি বা মৃত্যু নেমে আসবে অশান্তিকারীর ওপর। এই অভিশাপ নিয়ে গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয় যখন সমাধি আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন মানুষের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। হাওয়ার্ড কার্টারের পৃষ্ঠপোষক লর্ড কারনারভন সমাধিক্ষেত্র খোলার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রহস্যজনকভাবে মারা যান, যাতে অভিশাপের গল্প আরো বেশি করে প্রচার পায়। যদিও বিজ্ঞান এই ধরনের অতিপ্রাকৃত অভিশাপের ধারণাকে ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করেছে, তবুও এই গল্প লোককাহিনী হিসেবে বেঁচে আছে – মানুষের অজানাকে জানার আগ্রহ আর অলৌকিকের প্রতি ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ এটি।
অভিশাপের গল্পের বাইরেও তুতানখামুনের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে আসল রহস্য রয়েই গেছে। অল্প বয়সেই তিনি মারা যান। তার মমি পরীক্ষা করে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে বোঝা যায় তিনি নানা রকম শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে নানা জল্পনা আছে – বংশগত রোগ, ম্যালেরিয়া, এমনকি রথ দুর্ঘটনার কথাও বলা হয়। তত্ত্বের অভাব নেই, কিন্তু আসল কারণ আজও রহস্য, তা যেন তার মমির লিনেনের কাপড়ের মধ্যেই মুড়িয়ে আছে।