এই সমাজে এমন অনেক মানুষই আছে যাদের কোনো বন্ধু নেই, নেই কোনো বিশ্বস্ত সঙ্গী । আবার অনেকের বন্ধু থাকলেও তাদের থেকে দূরে থাকতেই তাঁরা ভালোবাসেন , নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন অন্যদের থেকে ।
এটাই নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ব । নিঃসঙ্গতাকে আমরা প্রায়শই শুধু একটা মানসিক অসুবিধা বলে মনে করি। কিন্তু আসলে এই নিঃসঙ্গতাই একটা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে যাতে শারীরিক এবং মানসিক, দুই দিক দিয়েই অসুস্থ হতে পারেন আপনি । নিঃসঙ্গতা আমাদের শারিরিক ও মানসিক স্বাস্থের ক্ষেত্রে কী প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে যা থেকে উঠে আসে এক ভয়ঙ্কর ছবি ।
নিঃসঙ্গতার ফলে শারীরিক সমস্যা
নিঃসঙ্গতা শুধু মনের একটা অবস্থা নয়; বরং একটা দীর্ঘস্থায়ী চাপের কারণ, যেটা শরীরে এমন কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটায়, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। গবেষণা বলে, প্রতিদিন ১৫ টি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতি করতে পারে নিঃসঙ্গতা (Holt-Lunstad, 2015)।
নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হলে, দেহের স্ট্রেস রেসপন্স সিস্টেম সক্রিয় হয়ে পড়ে, কর্টিসল নামে এক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই হরমোনের ভারসাম্যহীনতা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যা ডেকে আনে।
নিঃসঙ্গতার সঙ্গে হার্টের সমস্যার যোগাযোগ বিশেষভাবে উদ্বেগের। “হার্ট” পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগের অভাব হার্টের অসুখের ঝুঁকি ২৯% ও স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩২% বাড়ায়। (Valtorta et al., 2016)। একাকীত্বের স্ট্রেসের ফলে রক্তনালীতে প্রদাহ হয়, ধমনী শক্ত হয়ে যায় এবং আরও কিছু উপসর্গ দেখা দেয়, ফলে হার্টের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য এবং কগনিটিভ সমস্যা
নিঃসঙ্গতার প্রভাব কেবল শারীরিক সমস্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর গভীর প্রভাব পড়ে মানসিক স্বাস্থ্যেও। দীর্ঘস্থায়ী নিঃসঙ্গতা হতাশা, উদ্বেগ, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। নিঃসঙ্গতার ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের যে অবনতি হয়, তার ফলে আবার মানুষ আরও একা হয়ে যায়।
তার ওপর, নিঃসঙ্গতা কগনিটিভ বিকাশের সমস্যা বা ব্রেনের অবক্ষয়ের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে। অ্যালঝাইমার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক রিপোর্টে দেখা গেছে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষের ডিমেনশিয়ার সম্ভাবনা ৫০% বেশি (Alzheimer’s Association, 2020)। এর সম্ভাব্য কারণ হলো, সামাজিক মেলামেশার ফলে ব্রেইনে নতুন নিউরাল কানেকশন বা যোগসূত্র তৈরি হয়, এবং বয়সজনিত ব্রেনের অবনতির হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায়।
আয়ুষ্কাল
নিঃসঙ্গতা যে কতট সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়াতে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং নিঃসঙ্গতা অকালমৃত্যুর হার ২৬% পর্যন্ত বাড়ায় (Holt-Lunstad, 2015)। এই ঝুঁকির কারণগুলির তুলনা করা যেতে পারে স্থূলতা বা শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে। দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যসমস্যা বা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমগুলির ওপর স্ট্রেসের প্রভাব – এইসব মিলিয়ে নিঃসঙ্গতা আয়ু কমিয়ে দেয়।
নিঃসঙ্গতা হল একটা নীরব আর্তনাদ । নিঃসঙ্গতা কাটাতে গেলে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে নিজেকে , নিজেকে মেলে ধরতে হবে অন্যদের সাথে, প্রয়োজন কমিউনিটির অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, নিজের সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করা, এবং প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে শারীরিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাই একমাত্র স্থায়ী মুক্তির পথ ।