বিশাল মহাশূন্যের নিস্তব্ধতায় একটি লাল বিন্দু যা মানবজাতির অফুরন্ত কল্পনাকে আলোড়িত করে – মঙ্গল, আমাদের সামনের অভিযান। এই লাল গ্রহের মাটিতে মানুষের প্রথম পদচিহ্ন পড়ার সেই দিন আস্তে আস্তে কাছে আসছে, আর তার সাথে জেগে উঠছে এক চরম প্রশ্ন – আমাদের পৃথিবীর মতোই আমরা কি এই অচেনা গ্রহে চাষআবাদ করতে পারব? বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর রাজত্বে থাকা এই ধারণা এখন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
ভীনগ্রহের মাটিতে হবে বীজ বপন
মঙ্গলের পরিবেশের প্রধানত কার্বন-ডাই-অক্সাইড দিয়ে তৈরি হালকা বায়ুমণ্ডল। মঙ্গল যে মোটেই জীবন বান্ধব গ্রহ নয় তা বলা বাহুল্য। কিন্তু অদম্য মানুষের মন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর অক্লান্ত জানার ইচ্ছা সব বাধা পেরিয়ে এই অনুর্বর গ্রহকেও ফসলের ক্ষেতে পরিণত করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
মঙ্গল গ্রহে কৃষিকাজের প্রথম ধাপ শুরু হবে মাটি… বলা ভালো ‘রেগোলিথ’ দিয়ে, যে আলগা উপাদান দিয়ে মঙ্গলের বাইরের স্তরটি ঢাকা। পৃথিবীর মাটির বিপরীতে, মঙ্গলের মাটিতে প্রাণীর জন্য প্রয়োজনীয় কোনও পুষ্টিকর উপাদান নেই, বরং এই মাটিতে ছড়িয়ে আছে পার্ক্লোরেট – এক ধরণের রাসায়নিক যৌগ যা মানুষের জন্য খুবই বিষাক্ত। সুতরাং মঙ্গলের এই বন্ধ্যা মাটিকে চাষের উপযোগী করে তোলাই হবে প্রথম কাজ।
নাসা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের মাটি থেকে বিষাক্ত উপাদান সরিয়ে তাকে কৃষিযোগ্য করে তোলার নানান উপায় নিয়ে গবেষণা করছেন। এমন কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়া আছে যেগুলো পার্ক্লোরেট নিষ্কাশন করতে পারে, এমনকি সেগুলো কাজে লাগিয়ে উপকারী অক্সিজেন আর ক্লোরাইড বানানোও সম্ভব। সেই সাথে পৃথিবী থেকে কম্পোস্ট এনে এবং বিশেষ কিছু ব্যাকটেরিয়া চাষের মাধ্যমে মাটিকে উর্বর করা যেতে পারে।
মঙ্গল গ্রহে গ্রিনহাউস
লাল গ্রহের বুকে সবুজের ছোঁয়া দেখার স্বপ্ন আমাদের নিয়ে আসে বিশেষভাবে তৈরি ‘গ্রিনহাউসের’ ধারণায়, যেগুলো এই গ্রহের কঠিন পরিবেশ সামলে নিতে পারবে। এগুলো কিন্তু সাধারণ কাঁচের ঘরের মতো নয়, এগুলো প্রকৌশলের বিস্ময়। যেহেতু তাপমাত্রা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মঙ্গলে তাপমাত্রার মারাত্মক তারতম্য হয় এবং পৃথিবীর থেকে অনেক বেশি ক্ষতিকর মহাজাগতিক বিকিরণ হতে থাকে। তাই সম্ভবত মজবুত ও স্বচ্ছ পদার্থ দিয়ে এই কাঠামোগুলো তৈরি করা হবে, যা গাছকে ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে রক্ষা করার সাথে সাথে সূর্যের আলো ঢুকতে দেবে যাতে আলোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চলতে পারে। প্রাকৃতিক আলোর বিকল্প বা সম্পূরক হিসেবে এলইডি আলোও ব্যবহার করা যেতে পারে যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা যায়।
জলের সমস্যা মিটবে কিভাব
কৃষিকাজের মূল ভিত্তি হলো জল, আর সেই দিক থেকে মঙ্গল বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে উপস্থিত করে। মেরু অঞ্চলে এবং সম্ভবতঃ গ্রহের পৃষ্ঠের নীচে বরফের উপস্থিতি আশার আলো দেখায়। বরফ গলিয়ে সেই জল বিশুদ্ধকরণ মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু পৃথিবী থেকে যে সীমিত সম্পদ মঙ্গলে নিয়ে যাওয়া যাবে তা মাথায় রেখে এইসব প্রক্রিয়াগুলোকে অবশ্যই শক্তি সাশ্রয়ী এবং স্থায়ী করে তুলতে হবে।
চাষের উপযোগী পরিবেশে উদ্ভিদের জীবনধারণের জন্য মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল সামঞ্জস্য করা আরেকটি প্রতিবন্ধকতা। উদ্ভিদের যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড দরকার, তেমনই দরকার নির্দিষ্ট অনুপাতে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের নকল করে একটি কৃত্রিম ভারসাম্যপূর্ণ বায়ুস্তর তৈরি করা ফসল বাঁচানোর তাগিদেই করা লাগবে।
সম্ভবত শুরুতে মঙ্গলের মাটিতে খুব অল্প জায়গায় চাষ শুরু করা হবে – হয়ত এমন কিছু শক্তপোক্ত উদ্ভিদ দিয়ে যেগুলো কঠিন পরিবেশ সামলাতে পারে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু প্রজাতির দিকে তাকিয়ে আছেন যারা মঙ্গলের পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে । যেমন আলু, যেটির অনুর্বর মাটিতেও বেড়ে ওঠার ক্ষমতা আছে অথবা অন্যান্য শাকসবজি যেমন পালং শাক বা মুলা। মঙ্গল গ্রহের মাটিতে কৃষির এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো আরও উন্নত কৃষিপদ্ধতির পথ তৈরি করবে।
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে যেদিন মানুষ মঙ্গলের মাটিতে চাষ করা সদ্য ফলানো সব্জি খাবে সেদিনটা খুব বেশি দূরে নয়।