শসা! নামটা শুনেই আমাদের মনের মধ্যে একটা তরতাজা ভাব চলে আসে। আর হবে নাই বা কেন? এই সবুজ সবজিটি প্রায় ৯৫% জল দিয়ে তৈরি। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও চাষকৃত সবজিগুলোর মধ্যে শসা একটি, এবং ভারতেই এর উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, ক্যালোরির দিক থেকে শসা খুবই নিরাপদ, এতে কোনো স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা কোলেস্টেরল নেই।
শসার মধ্যে কী কী উপাদান থাকে ও তাদের ভূমিকা দেখে নিন এক ঝলকে
ভিটামিন ও মিনারেল | পরিমাণ (প্রতি 100 গ্রাম) | উপকারিতা |
---|---|---|
ভিটামিন এ | 26 µg | দৃষ্টিশক্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী |
ভিটামিন সি | 21 mg | রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কোলাজেন উৎপাদন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে |
ভিটামিন কে | 16.7 µg | হাড়ের স্বাস্থ্য, রক্ত জমাট বাঁধা এবং রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে |
পটাশিয়াম | 195 mg | রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, স্নায়ু ও পেশীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে |
ম্যাগনেসিয়াম | 15 mg | পেশীর শিথিলকরণ, স্নায়ু তন্ত্রের কার্যকারিতা এবং শক্তির উৎপাদনে সহায়তা করে |
ক্যালসিয়াম | 18 mg | হাড় ও দাঁতের গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে |
ফসফরাস | 22 mg | হাড় ও দাঁতের গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, শক্তির উৎপাদনে ভূমিকা রাখে |
ফোলেট | 19 µg | নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে, গর্ভবতী মহিলাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ |
ম্যাঙ্গানিজ | 0.3 mg | হাড়ের গঠন, কোলাজেন উৎপাদন এবং শক্তির উৎপাদনে সহায়তা করে |
ক্লোরিন | 42 mg | তরল ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং হজমে সাহায্য করে |
শসার উপকারিতা:
১)দেহে জলের ভারসাম্য রাখে:
শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে এবং দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে শসা অসাধারণ কাজ করে। এতে থাকা জল শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতেও সাহায্য করে।
২)ভিটামিন ও খনিজের আধার:
ভিটামিন এ, বি১, বি৬, সি ও ডি ছাড়াও শসায় রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, এবং পটাশিয়াম। দৈনন্দিন ভিটামিনের প্রয়োজনের একটি বড় অংশপূরণ করে দিতে পারে। শসা ও গাজরের রস একসাথে খেলে গেঁটেবাত এবং বাতের ব্যথা অনেকটাই কমে যায়, কারণ এটি দেহের ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমায়।
৩)ত্বকের যত্নে শসা :
ত্বক টানটান করতে, চোখের ফোলাভাব কমাতে এবং আরও নানা চর্মরোগের সমাধানে শসা দারুণ কার্যকরী। শসা দিয়ে তৈরি ফেসমাস্ক ত্বককে করে তোলে অনেক বেশি টানটান। দশ-পনেরো মিনিট চোখের উপর শসা র কুচি রাখলে চোখের ফোলাভাব অনেকটাই কমে যাবে, সেই সাথে আরামও পাওয়া যায়।
৪)সেলুলাইট দূর করতে কাজে আসে:
অপ্রয়োজনীয় সেলুলাইট দূর করতেও শসা দারুণ কাজ দেয়। সমস্যাযুক্ত স্থানে কয়েক মিনিট শসার কুচি ঘষলে উপকার পাওয়া যায়। শসাতে থাকা ফাইটোকেমিক্যাল ত্বকের কোলাজেনকে মজবুত করে, বাইরের স্তরকে টানটান করে, এবং সেলুলাইটের দৃশ্যমানতা কমিয়ে দেয়।শসা খেলেও একই উপকার পাওয়া যায়।
৫)রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ:
শসায় রয়েছে প্রচুর পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফাইবার, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষভাবে সহায়ক। উচ্চ রক্তচাপ এবং নিম্ন রক্তচাপ – দুই সমস্যার ক্ষেত্রেই শসার রস উপকারী। শসার রসে থাকা বিশেষ একটি হরমোন অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলিকে ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও বেশ উপকারী।
৬)হজমশক্তি ও ইমিউনিটি:
সকালে খালি পেটে নিয়মিত শসার রস খেলে হজমশক্তির উন্নতি হয় এবং অ্যাসিডিটি, হার্টবার্ন, গ্যাস্ট্রাইটিস ইত্যাদি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। শসার উচ্চ জলের পরিমাণ এবং ফাইবার পরিপাকতন্ত্র থেকে টক্সিন বের করে দিয়ে হজমে সাহায্য করে।
৭) নিয়মিত শসা খেলে দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হতে পারে।
৮)জয়েন্টের স্বাস্থ্য:
শসার অন্যতম উপাদান সিলিকা জয়েন্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং কানেক্টিভ টিস্যুগুলিকে মজবুত করে।
৯)হ্যাঙ্গওভার কমাতে:
কয়েক টুকরো শসা খেলে হ্যাঙ্গোভার এবং মাথাব্যথা প্রতিরোধ করা যায়। এতে থাকা চিনি, ভিটামিন বি ও ইলেক্ট্রোলাইট শরীরে পুষ্টির ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে হ্যাঙ্গোভার ও মাথাব্যথা দূর করতে সহায়তা করে।
১০)দুশ্চিন্তা কমাতে:
পুরো একটি শসা কেটে ফুটন্ত জলে দিন। শসা থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ ও পুষ্টি উপাদানগুলি ভাপের সাথে মিশে যাবে। এই ভাপ নিলে নতুন মা এবং কলেজপড়ুয়াদের পরীক্ষার সময়কার দুশ্চিন্তা কমে যায়।
শসার বেশ কিছু অজানা ব্যবহার সম্পর্কে জেনে নিন:
১)জুতো পালিশ:
তাড়াহুড়োয় জুতো পালিশ করার সময় নেই? চিন্তা নেই! কেটে নেওয়া শসা দিয়ে জুতো ঘষলেই চকচকে হয়ে উঠবে। এতে আঙুলে বা নখেও কোনো ক্ষতি হবে না।
২)স্টেইনলেস স্টিল পরিষ্কার:
স্টেইনলেস স্টিলের সিঙ্ক বা অন্য যেকোনো বাসনপত্রের বহুদিনের দাগ দূর করতে কাজে লাগবে শসা । এটা দাগ তুলতে যেমন সাহায্য করবে, তেমনি চকচকে ভাবও ফিরিয়ে আনবে।
৩)বাথরুমের আয়না:
স্নানের পর বাথরুমের আয়না যদি কুয়াশাযুক্ত হয়ে যায়, শসার টুকরো ঘষলে তা দূর হয়ে যাবে এবং আয়নায় চকচকে ভাব এসে যাবে।
৪)পেনের দাগ মুছে ফেলতে:
কলমের দাগ মুছে ফেলতে শসার খোসা ব্যবহার করা যায়। এটি দেয়ালে লেখা ক্রেয়ন বা মার্কারের দাগ দূর করতেও কাজে আসে।
৫)বাগানে পোকামাকড় দূর করতে:
বাগানে কয়েক টুকরো শসা রাখলে পোকামাকড়, শামুক, এবং ক্ষতিকর প্রাণী দূরে থাকে। শসার রাসায়নিক পদার্থ অ্যালুমিনিয়ামের সাথে প্রতিক্রিয়া করে একটি অদ্ভুত গন্ধ তৈরি করে যা মানুষের কাছে অনুভূত হয় না, কিন্তু বাগানের পোকামাকড়দের জন্য অসহ্য।
শসার জুস তৈরির পদ্ধতি:
শসা র রস একটি সতেজ এবং বহুমুখী পানীয়। ত্বকের উন্নতি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, এবং আরও অনেক কিছুর জন্য অনেকে এই ঠান্ডা পানীয় পান করেন। শসার জুস তৈরির দুটি সহজ রেসিপি এখানে দেওয়া হলো:
সাধারণ শসার জুস
৩টি মাঝারি আকারের শসা ও জল
প্রণালী:
- শশা ভালো করে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে নিন।
- শশার টুকরোগুলো ব্লেন্ডারে দিয়ে মসৃণ করে নিন।
- একটি বড় বাটির উপরে একটি চালনি রাখুন এবং চালনিতে মসলিন কাপড় বিছিয়ে দিন।
- ব্লেন্ড করা শশার মিশ্রণটি চালনিতে ঢেলে ছেঁকে নিন।
- একটি গ্লাসে রস ঢেলে পরিবেশন করুন।
মিষ্টি শসার জুস:
- ১টি মাঝারি আকারের শসা
- ২ কাপ জল
- ২ টেবিল চামচ চিনি
- ২ টেবিল চামচ মধু
- স্বাদ অনুযায়ী লবণ
প্রণালী:
- শসা ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে কোড়া করে নিন।
- একটি পাত্রে জল ও চিনি দিয়ে মাঝারি আঁচে ফুটিয়ে নিন।
- জল ঘন হয়ে এলে কোড়া করা শসা জলে দিন।
- শসা জলের সাথে ভালোভাবে মিশে গেলে চুলা থেকে নামিয়ে নিন এবং মিশ্রণটি ঠান্ডা করে নিন।
- ঠান্ডা মিশ্রণটি ব্লেন্ডারে দিয়ে মধু ও লবণ মিশিয়ে নিন।
- একটি চালনি দিয়ে রস ছেঁকে নিন।
- ঠান্ডা করে বরফের সাথে পরিবেশন করুন।