প্রকৃতির কল্যানে আমাদের বাংলায় সবুজ গাছপালার অভাব নেই । এই সব গাছপালা গুলির মধ্যে কত যে অসাধারণ গুণ লুকিয়ে আছে তা আমরাই জানিনা । প্রকৃতি যেন সব সময়ই রহস্য মুঠোবন্দী করে আমাদের চমকে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ।
প্রকৃতির তেমনই এক রহস্য হল মরিঙ্গা ওলেইফেরা গাছ , আমরা যাকে সজনে বলে চিনি । সজনে এক অদ্ভুত গাছ এর ফল , ফুল , পাতা সবেতেই আছে দুর্দান্ত ঔষাধিগুণ । সারা বিশ্বব্যাপী মরিঙ্গা একটি সুপারফুড হিসেবে পরিচিত ।
‘মরিঙ্গা পাউডার‘ মানে সোজা ভাষায় বললে সজনে পাতার গুঁড়ো শুধু যে পুষ্টির ভাণ্ডার তা নয়, বরং বিভিন্ন গবেষণায় হৃৎপিণ্ডের জন্য উপকারী বলে স্বীকৃতি পেয়েছে ।
সজনে পাতার গুঁড়ো ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর । গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই গুঁড়োয় প্রচুর ভিটামিন সি, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং অ্যামিনো অ্যাসিড আছে, যা সুস্থ শরীর এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য খুব দরকারী ।
হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য মরিঙ্গা পাতার গুঁড়ো খুব উপকারী হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হল এর কোলেস্টেরল কমানোর ক্ষমতা। উচ্চ কোলেস্টেরল হৃদরোগের জন্য একটি বড় ঝুঁকি, কারণ এটি ধমনী ব্লক করে রক্ত চলাচল কমিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মরিঙ্গা পাতায় প্রাকৃতিকভাবে কোলেস্টেরল কমানোর গুণ আছে। “জার্নাল অফ এথনোফার্মাকোলজি” তে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মরিঙ্গা পাতার গুঁড়ো লিপিড এবং গ্লুকোজের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, যার ফলে ধমনীতে প্লাক তৈরি হতে বাঁধা দেয় এবং হৃদযন্ত্রের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
প্রদাহ বিরোধী গুণের জন্যও এই গুঁড়ার বেশ প্রচলন রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী যে কোন প্রদাহই অনেক রোগের কারণ হতে পারে, যার মধ্যে হৃদরোগও রয়েছে। সজনে পাতার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন কোয়েরসেটিন এবং ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড, প্রদাহ কমিয়ে কোষের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে।
হৃৎপিণ্ডের পাশাপাশি সজনে পাতার গুঁড়ো সামগ্রিকভাবে ভালো থাকতে সাহায্য করে। এর প্রচুর পরিমাণ আয়রণ অ্যানিমিয়া (রক্তাল্পতা) দূর করতে কাজে লাগে, আবার এর ক্যালসিয়াম হাড় ভালো রাখতে সাহায্য করে। শুধু তা-ই নয় এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় তা পরিপাকে সাহায্য করে এবং সুস্থ ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা পরোক্ষভাবে হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে কাজ করে।
আর এই বহুমুখী গুনের জন্যই সজনেকে পারফুড বলা হয় । সুপারফুড বলতে বোঝায় সেইসব খাবার যেগুলো ব্যতিক্রমীভাবে পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। সজনে শুধু এই সংগায় পড়ে না বরং এর বহুবিধ উপকার দিয়ে অন্য সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়।
এক ঝলকে দেখে নিন সজনে পাতার গুঁড়োতে কী কী উপাদান আছে এবং তা আমাদের শরীরে কী কী উপকার করে
পুষ্টি উপাদান | ১০০ গ্রামে পরিমাণ | স্বাস্থ্য উপকারিতা |
---|---|---|
প্রোটিন | ২৭.১ গ্রাম | পেশীর বৃদ্ধি এবং পেশী গঠনে কাজ করে। এনজাইম ও হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে। |
ফাইবার | ১৯.২ গ্রাম | পরিপাকে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, এবং রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। |
ক্যালসিয়াম | ২০.০৩ মিলিগ্রাম | হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি এবং পেশি এবং নার্ভের কাজে ভূমিকা রাখে। |
লৌহ | ২৮.২ মিলিগ্রাম | হিমোগ্লোবিন উৎপাদন এবং শরীরে অক্সিজেন পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অ্যানিমিয়া রোধ করে। |
ভিটামিন এ | ১৬.৩ মিলিগ্রাম | দৃষ্টিশক্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। |
ভিটামিন সি | ১৭.৩ মিলিগ্রাম | অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে যা কোষের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। |
পটাসিয়াম | ১৩২৪ মিলিগ্রাম | হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। শরীরে তরলের ভারসাম্যের জন্য অত্যাবশ্যক। |
ম্যাগনেসিয়াম | ৩৬৮ মিলিগ্রাম | পেশী এবং নার্ভের কাজে, শক্তি তৈরী সহ শরীরের ৩০০ এরও বেশি বায়োকেমিক্যাল বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। |
জিঙ্ক | ৩.২৯ মিলিগ্রাম | রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ক্ষত সারাতে কাজ করে এবং ডিএনএ তৈরিতে সাহায্য করে। |
ভিটামিন বি৬ | ১.২ মিলিগ্রাম | স্বাভাবিক মস্তিষ্কের বিকাশে এবং সুস্থ নার্ভাস সিস্টেম ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। |
ভিটামিন ই | ১১৩ মিলিগ্রাম | একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, কোষ রক্ষায় এবং ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। |
রাইবোফ্লাভিন (ভিটামিন বি২) | ২০.৫ মিলিগ্রাম | কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং ফ্যাট ভেঙে শক্তি তৈরি করতে সাহায্য করে, এবং শরীরে অক্সিজেনকে ব্যবহার উপযোগী করে। |
থায়ামিন (ভিটামিন বি১) | ২.৬৪ মিলিগ্রাম | শক্তি বিপাকে এবং কোষের কাজে সাহায্য করে। |
নিয়াসিন (ভিটামিন বি৩) | ৮.২ মিলিগ্রাম | হজম শক্তি, ত্বক ও নার্ভস সিস্টেমকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও শক্তির জন্য খাবারকে কাজে লাগাতে সাহায্য করে। |
ফলিক অ্যাসিড (ভিটামিন বি৯) | ১০৩০ মাইক্রোগ্রাম | ডিএনএ এবং আরএনএ তৈরি এবং কোষ বিভাজনের জন্য মেটাবলিজম-এ অত্যাবশ্যক। |
ফসফরাস | ২০৪ মিলিগ্রাম | হাড় এবং দাঁত তৈরিতে সাহায্য করে। কোষীয় স্তরে শরীরে কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটকে শক্তিতে পরিণত করতে সাহায্য করে। |
কপার | ০.৫৭ মিলিগ্রাম | লাল রক্তকণিকা তৈরি, নার্ভের কোষ রক্ষা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো রাখতে জরুরি। |
সেলেনিয়াম | ৮.২ মাইক্রোগ্রাম | মেটাবলিজম এবং থাইরয়েডের কাজ, শরীরকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে অপরিহার্য। |
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড | ১.৭ গ্রাম | হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য, প্রদাহ কমানো, এবং মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রক্ষায় সাহায্য করে। |
কীভাবে খাবেন এই সজনে পাতার গুঁড়ো
খাবার তালিকায় সজনে পাতার গুঁড়ো রাখা খুবই সহজ এবং নানা ভাবে খাওয়া যেতে পারে। পুষ্টিকর স্যুপে একটু মিশিয়ে খাওয়া যায় বা সকালে যেটা খাচ্ছেন তার উপরে ছিটিয়ে নিলেন । তবে সব থেকে সুবিধাজনক পথ হল চা -এর মত করে খাওয়া , গরম জলে দু চামাচ দিয়ে দিলান । যারা সজনে পাতার গুঁড়ো নতুন নতুন ব্যবহার করতে চান তারা এক চা-চামচ গুঁড়ো দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়াতে পারেন।
উপকারিতা সত্ত্বেও, নতুন যে কোনো কোন সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার আগে বিশেষ করে যাদের আগে থেকে কোন শারীরিক সমস্যা আছে অথবা ওষুধ খাচ্ছেন তাদের ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত।