গর্ভফুল, মায়ের গর্ভে থাকা এক অপূর্ব সৃষ্টি যা অনাগত শিশুর জীবনধারণের প্রধান মাধ্যম। এই গর্ভফুলের মাধ্যমেই মায়ের শরীর থেকে শিশুর শরীরে পুষ্টি, অক্সিজেন এবং বর্জ্য পদার্থের আদান-প্রদান হয়। একই সঙ্গে এটি ক্ষতিকর উপাদানের বিরুদ্ধে এক প্রতিরক্ষামূলক বাধা হিসেবেও কাজ করে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় গর্ভফুল কীভাবে কাজ করে, সেই সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জানাশোনা এতদিন ছিল বেশ সীমিত। কারণ, গর্ভফুলের কাজকর্ম সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে গেলে যেসব পদ্ধতির (যেমন বায়োপসি) প্রয়োজন হয়, তাতে মায়ের এবং অনাগত শিশুর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থেকেই যায়।
বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি: প্লাসেন্টা-অন-অ্যা-চিপ
কিন্তু “প্লাসেন্টা-অন-অ্যা-চিপ” নামের এক যুগান্তকারী প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে প্রসবপূর্ব স্বাস্থ্যসেবায় যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সহযোগী অধ্যাপক নিকোল হাসেমি এবং তাঁর গবেষণা দলের দিনরাত পরিশ্রমের ফসল এই অভিনব প্রযুক্তি। এই যন্ত্রটি আকারে ছোট হলেও (মাত্র একটা ক্রেডিট কার্ডের সমান) কাজের দিক থেকে কিন্তু ভীষণ শক্তিশালী। এর মধ্যে দুটো ক্ষুদ্র চ্যানেল রয়েছে, যাদের মাঝখানে একটা ছিদ্রযুক্ত পর্দা। এই চ্যানেল দুটো মায়ের এবং ভ্রূণের রক্ত প্রবাহকে উপস্থাপন করে, আর পর্দাটি কাজ করে গর্ভফুলের বাধার মতো। এই সেটআপের মাধ্যমেই গবেষকরা দেখতে পারছেন, ওষুধ বা পুষ্টির মতো বিভিন্ন উপাদান কীভাবে মায়ের শরীর থেকে ভ্রূণে এবং ভ্রূণ থেকে মায়ের শরীরে যাতায়াত করে।
এই ছোট্ট যন্ত্রের আসল কেরামতি এর মাইক্রো-ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। চ্যানেলগুলো এতই ক্ষুদ্র যে, সেগুলোর প্রস্থ আর উচ্চতা মিটারের মাত্র লক্ষ ভাগের এক ভাগ। এত ক্ষুদ্র হওয়ায় এরা আসল গর্ভফুলের বাধার কাজটা নিখুঁতভাবে অনুকরণ করতে পারে। আর যখন এই চ্যানেলগুলোতে এন্ডোথেলিয়াল কোষ (মানব গর্ভফুলে প্রাকৃতিক বাধা তৈরি করে যে কোষ) দিয়ে সজ্জিত করা হয়, তখন যন্ত্রটি আরও বেশি করে আসল গর্ভফুলের মতো কাজ করে।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত
গবেষণার কাজে তো বটেই, এই “প্লাসেন্টা-অন-অ্যা-চিপ” ব্যক্তিগত চিকিৎসায় (personalized medicine) এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে। একজন রোগীর নিজস্ব কোষ ব্যবহার করে একটি মডেল তৈরি করে, গবেষকরা খুব নির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেন। এতে করে বোঝা যায় কোন ওষুধ বা উপাদান নির্দিষ্ট কোনো মায়ের বা শিশুর জন্য কতটা নিরাপদ। এমনকি, প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা করে চিকিৎসার মাত্রা নির্ধারণ করাও সম্ভব হবে।
২০১৫ সালে প্রথম আবির্ভাব হওয়ার পর থেকে এই প্রযুক্তি নিয়ে ক্রমাগত গবেষণা চলছে। ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের (NSF) একটি অনুদান পেয়ে হাসেমি এবং তাঁর দল এখন আরও উন্নত সেন্সর, ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা, এমনকি এই যন্ত্রের বাণিজ্যিকীকরণ নিয়েও ভাবছেন।
এই যন্ত্রের সাহায্যে তারা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। যেমন, তারা দেখেছেন ক্যাফেইন কীভাবে গর্ভফুলের বাধা পেরিয়ে মায়ের শরীর থেকে শিশুর শরীরে যায়। এছাড়াও, ন্যানোমেডিসিন নিয়েও তারা গবেষণা করছেন, যা ভবিষ্যতে ওষুধের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
“প্লাসেন্টা-অন-এ-চিপ” প্রযুক্তিটি কীভাবে কাজ করবে
গর্ভাবস্থার সময় নমুনা সংগ্রহ:
- একজন গর্ভবতী মায়ের প্লাসেন্টা থেকে কোষ সংগ্রহ করা হবে।
- এই কোষগুলিকে একটি বিশেষ চিপে স্থাপন করা হবে যা মানব প্লাসেন্টার কার্যপ্রণালীর অনুকরণ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
- চিপটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হবে।
ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
- গবেষকরা নতুন ওষুধ এবং চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে প্লাসেন্টা-অন-এ-চিপ ব্যবহার করতে পারবেন।
- এটি গর্ভবতী মায়েদের এবং তাদের শিশুদের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই করা যাবে।
- এর ফলে গর্ভাবস্থায় দেখা দেওয়া বিভিন্ন জটিলতার আরও ভাল চিকিৎসা সম্ভব হবে।
গর্ভাবস্থায় জটিলতা রোধ:
- প্লাসেন্টা-অন-এ-চিপ ব্যবহার করে, গবেষকরা গর্ভাবস্থায় জটিলতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের আরও আগে থেকেই চিহ্নিত করতে পারবেন।
- এর ফলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অনেক জটিলতা রোধ করা সম্ভব হবে।
শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নতি:
- প্লাসেন্টা-অন-এ-চিপ গবেষকদের গর্ভের পরিবেশ এবং শিশুর বিকাশের উপর এর প্রভাব আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
- এর ফলে শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য যে, প্লাসেন্টা-অন-এ-চিপ প্রযুক্তিটি এখনও তার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এটি কীভাবে ব্যবহার করা হবে এবং এর ভবিষ্যতের প্রভাব কী হবে তা এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে, এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বলে মনে করা হচ্ছে।