মানবদেহের সবচেয়ে জটিল অঙ্গ মস্তিষ্ক । এই মস্তিষ্কের এর সঙ্গে যুক্ত স্নায়ুতন্ত্র মিলে আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (CNS) গঠন করে। এই স্নায়ুতন্ত্র শরীরের প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও তাদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে । মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ আমাদের ইন্দ্রিয়, চিন্তাশক্তি, চলাফেরা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে মস্তিষ্কের গোড়া থেকে মেরুদণ্ড বরাবর যে স্নায়ু বা নার্ভ চলে গেছে তাকে বলা হয় সুষুম্না কাণ্ড, যা মস্তিষ্কের নির্দেশ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌঁছে দেয়।
মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে যে স্ট্রোক হয় তার নাম ইসকেমিক স্ট্রোক। এই রক্ত সরবরাহে বাধা সৃষ্টি হয় মূলত রক্তনালীতে কোনো রক্ত জমাট বাঁধার (blood clot) কারণে। এর ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না, ফলে মারাত্মক স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্ট্রোকের মধ্যে লার্জ ভেসেল অক্লুশন (LVO) সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ এতে মস্তিষ্কের বড় ধমনীগুলোতে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। সময়মতো এর চিকিৎসা না হলে মস্তিষ্কের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।
ব্রিগহ্যাম অ্যান্ড উইমেন্স হসপিটালের বিজ্ঞানীরা অন্যান্য গবেষকদের সাথে মিলে একটি অভিনব রক্ত পরীক্ষা উদ্ভাবন করেছেন যা দ্রুত এই LVO স্ট্রোক শনাক্ত করতে পারে। এই পরীক্ষায় রক্তে নির্দিষ্ট কিছু প্রোটিনের মাত্রা এবং FAST-ED নামে একটি ক্লিনিকাল স্কোর ব্যবহার করা হয়।
এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ডি-ডাইমার এবং গ্লিয়াল ফাইব্রিলারি অ্যাসিডিক প্রোটিন (GFAP) নামে দুটি প্রোটিনের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছেন। ডি-ডাইমার হলো রক্ত জমাট ভাঙার পর উৎপন্ন এক ধরনের প্রোটিন। রক্ত জমাট জনিত সমস্যা যাদের আছে, তাদের ডি-ডাইমারের মাত্রা সাধারণত বেশি থাকে। অন্যদিকে GFAP হলো মস্তিষ্কের এক ধরনের কোষের প্রোটিন, যা মস্তিষ্কের আঘাত বা রক্তক্ষরণের পর রক্তে নিঃসৃত হয়।
এর আগে এই দুটি প্রোটিনকে মাথার আঘাত এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের সাথে সম্পর্কিত মনে করা হত । এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল FAST-ED স্কোরের সাথে এই প্রোটিনগুলোর মাত্রা একত্রিত করে LVO স্ট্রোক নির্ণয়ের একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি বের করা।
FAST-ED হলো স্ট্রোকের তীব্রতা নির্ণয়ের একটি ক্লিনিকাল স্কোর যা মুখমণ্ডলের অসাড়তা, হাতের দুর্বলতা, কথা বলায় অসুবিধা, চোখের সমস্যা ইত্যাদি বিবেচনা করে। এই স্কোরের সাথে রক্তের প্রোটিনের মাত্রা একত্রিত করলে রোগ নির্ণয়ের নির্ভুলতা আরও বাড়ে।
এই গবেষণায় মে ২০২১ থেকে আগস্ট ২০২২ সালের মধ্যে ফ্লোরিডার ৩২৩ জন স্ট্রোক রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। ফলাফল দেখা যায় যে GFAP এবং ডি-ডাইমারের মাত্রা FAST-ED স্কোরের সাথে একত্রিত করলে LVO স্ট্রোক নির্ণয়ের স্পষ্টতা ৯৩ শতাংশ এবং সংবেদনশীলতা ৮১ শতাংশ, যদি লক্ষণ শুরু হওয়ার ছয় ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষা করা হয়।
এই আবিষ্কারটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং LVO স্ট্রোকের লক্ষণ অনেকটা একই রকম হতে পারে। দুটির মধ্যে পার্থক্য করা জরুরি পরিস্থিতিতে কঠিন হতে পারে, অথচ দুটির চিকিৎসা আলাদা। LVO স্ট্রোকের চিকিৎসায় রক্ত জমাট অপসারণের জন্য যান্ত্রিক থ্রম্বেক্টমি ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।
গবেষক দলের প্রধান ডাঃ জশুয়া বার্নস্টক মনে করেন যে, এই রক্ত পরীক্ষাটি বিশেষ করে যেসব দেশে উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব সেসব দেশে স্ট্রোকের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
এই রক্ত পরীক্ষার সম্ভাবনা যাচাই করতে গবেষকরা এখন অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করছেন। তাদের লক্ষ্য হলো স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্সেই এই পরীক্ষা করে ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সরাসরি চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। এর ফলে চিকিৎসা শুরু করতে যে দেরি হতো তা অনেক কমে যাবে, ফলে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারবেন।
ডাঃ বার্নস্টক বলেন, “স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সময়ই সব। যত দ্রুত রোগীকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া যাবে, তার ফলাফল তত ভালো হবে। প্রাথমিক পর্যায়েই রক্তক্ষরণ আছে কি নেই, অথবা অন্য কোনো হস্তক্ষেপ দরকার কি না, তা নির্ণয় করা গেলে চিকিৎসায় আমূল পরিবর্তন আসবে।”
এই আবিষ্কার স্ট্রোক চিকিৎসায় একটি বড় অগ্রগতি হলেও, এখনো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যেমন, এই পরীক্ষার নির্ভুলতা আরও বাড়ানো, সবার জন্য সহজলভ্য করা, এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে এর সমন্বয় সাধন করা।
তবে সামগ্রিকভাবে এই নতুন রক্ত পরীক্ষাটির সম্ভাবনা অনেক। এটি স্ট্রোকের চিকিৎসায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যা ভবিষ্যতে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের হার অনেক কমিয়ে আনতে পারে। এর ফলে স্বাস্থ্য খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন।