ইয়েমেনের সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জের গাছ হলেও, ড্রাগন ব্লাড ট্রি (Dracaena cinnabari) দেখতে একেবারে অন্য কোনো গ্রহের প্রাণীর মতো। ৬৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে থাকা এই গাছের পাতাগুলো ছাতার মতো মুখোমুখি, যা দেখে মনে হবে কেউ ছাতা খুলে রেখেছে। গাছের কাণ্ড কাটলে বেরিয়ে আসে রক্তের মতো লাল আঠা, যা ‘ড্রাগন’স ব্লাড‘ নামে পরিচিত। গাছের অনন্য ছাতার মতো আকৃতি, গভীর লাল রঙের রস – সব মিলিয়ে একে এক অদ্ভুত সুন্দর রূপ দিয়েছে। লোককাহিনীতে গাছের রসকে ড্রাগনের রক্তের সাথে তুলনা করা হয়, আর সেখান থেকেই এর নামকরণ।
গাছের এই লাল রস প্রাচীনকাল থেকেই বহুমূল্য। একদিকে যেমন এর ঔষধি গুণ রয়েছে বলে মনে করা হয়, অন্যদিকে রঙ তৈরিতেও এই রসের ব্যবহার আছে। আজও ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ও শিল্পকলায় এই রসের চাহিদা রয়েছে। রসের রঙ এতটাই আলাদা যে, যেখানে এই গাছ জন্মায়, সেই অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে এই রস গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
ড্রাগন ব্লাড ট্রি (ড্রাকাইনা সিনাবারি) সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জের একটি স্থানীয় গাছ। এটি একটি সাকুলেন্ট মনোকোটাইলেডন, যার অর্থ এটি পানি ধরে রাখার জন্য মোটা কান্ড এবং পাতা রয়েছে। ড্রাগন ব্লাড ট্রি এর গাঢ় লাল রজনের জন্য নামকরণ করা হয়েছে, যা কাটা বা আহত হলে বের হয়। রজনটিকে একবার ঔষধি বৈশিষ্ট্যযুক্ত বলে মনে করা হয় এবং এটিকে বার্নিশ এবং রং তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল।
ড্রাগন ব্লাড ট্রি ধীর-বর্ধনশীল গাছ যা 10 মিটার (33 ফুট) পর্যন্ত উঁচুতে পৌঁছাতে পারে। এটির একটি ছাতা-আকৃতির চাঁদনি রয়েছে যা পাতায় ঘনিয়ে থাকে। পাতাগুলি লম্বা এবং সরু, তীক্ষ্ণ হয়। গাছের ফুলগুলি ছোট এবং সাদা, এবংগুলি ঘন ক্লাস্টারে সাজানো হয়।
ড্রাগন ব্লাড ট্রি শুষ্ক, পাথুরে পরিবেশে বেঁচে থাকে। এটি সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জের স্থানীয়, যা ভারত মহাসাগরের আফ্রিকার উপকূলে অবস্থিত। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের রিপোর্ট অনুযায়ী, সোকোত্রার ৯৫% স্থল শামুক, ৯০% সরীসৃপ এবং ৩৫টিরও বেশি অদ্ভুত প্রজাতির প্রাণী দেখা যায় । তার অনন্য জীববৈচিত্র্যের জন্য এটিকে২০০৮ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে।
ড্রাগন ব্লাড ট্রি একটি বিপন্ন প্রজাতি। এটি আবাসস্থল ধ্বংস এবং অতিরিক্ত কাটার হুমকির মুখে রয়েছে। গাছটিকে রক্ষা করার জন্য সংরক্ষণ প্রচেষ্টা চলছে, যার মধ্যে রয়েছে নার্সারিতে গাছের চাষ এবং সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জে এর আবাসস্থল রক্ষা করা। ড্রাগন ব্লাড ট্রির পরিবেশগত ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ঘন ছায়া প্রখর রোদের তাপ থেকে বাঁচায় এবং কুয়াশা থেকে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে, যা আবার অন্যান্য প্রজাতির বাসস্থান তৈরিতে উপকারি।
কিন্তু আবহাওয়া পরিবর্তন এবং মানুষের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের ফলে ড্রাগন ব্লাড ট্রির অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। বৃষ্টিপাতে ভারসাম্যহীনতা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, এবং বাসস্থান ধ্বংসের জন্য গাছের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা প্রভাবিত হচ্ছে। এই বিখ্যাত প্রজাতির হারিয়ে যাওয়া ঠেকাতে আজ সংরক্ষণের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। শুধু গাছটির বাসস্থান রক্ষার মাধ্যমেই হয়তো এদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। সেইসাথে এই গাছের পরিবেশগত এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোও সমান জরুরি।
ড্রাগন ব্লাড ট্রি শুধু প্রকৃতির বিস্ময়ই নয়, আমাদের এই গ্রহের জীববৈচিত্র্যের ভঙ্গুর সৌন্দর্যেরও প্রতীক। গাছটির অস্তিত্ব নির্ভর করে এর বাসস্থলের সুস্থতার উপর, এবং এই মূল্যবান পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের সুচিন্তিত পদক্ষেপের ওপর।