বাঙালি এবং পেটের রোগের মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে । মানে বাঙালি হলেই তাঁর গ্যাস অম্বল বদহজমের সমস্যা থাকবে এমনটাই যেন স্বাভাবিক । আসলে এজন্য অনেকটাই দায়ী আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবন এবং খাদ্যাভ্যাস ।
আর এই দৈনন্দিন পেটের সমস্যার জন্য মুঠো মুঠো গ্যাসের ওষুধ এবং এন্টাসিড খাওয়া মোটেই কোনো সুস্থ লক্ষণ নয় , বরং উচিৎ খাদ্যাভ্যাসের সাথে সাথে জীবনযাত্রার মান পালটানো । আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঠিক এটাই করে গিয়েছেন । পাশাপাশি তাঁরা এমন সব দেশজ ফল এবং গাছপালা ব্যবহার করতেন যাতে অনায়াসেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত এই সব সমস্যাকে ।
তেমনই এক দেশজ ফল হল- ফলসা । যার বিজ্ঞানসম্মত নাম – Grewia asiatica । এই ফলটি এর স্বতন্ত্র টক স্বাদ এবং বহুবিধ স্বাস্থ্যগুণের জন্য বিখ্যাত । এই ছোট্ট ফলটি পুষ্টির এক আধার যদিও একটা সময় আমাদের এই বাংলাতে প্রচুর পরিমাণে ফলসা গাছ দেখা যেত কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা নামমাত্র ।
ফলসা একটা পর্ণমোচী গুল্ম জাতীয় গাছ, যা প্রধানত উষ্ণ অঞ্চল যেমন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে পাওয়া যায়। মে থেকে জুলাই, এই প্রখর গরমকালে ফলসার মরশুম। এতে আছে একটা রসালো টক স্বাদ যে কারণে গরমে শরীর জুড়ানো একটা পানীয় হিসেবেও খাওয়া হয় অথবা সরাসরি ফল হিসেবেও খাওয়া হয়।
পেটের সমস্যায় ফলসা
কিন্তু ফলসার আসল যাদু লুকিয়ে আছে এর ঔষধি গুণে। বহু যুগ ধরেই হজম সংক্রান্ত নানান সমস্যার সমাধানে ফলসার ব্যবহার হয়ে এসেছে। পেটের সমস্যা যেমন গ্যাস, অম্বল, বদহজম – সব ক্ষেত্রেই ফলসা কার্যকরী । এর উচ্চ ফাইবার হজম প্রক্রিয়া সচল রাখতে এবং সুষ্ঠু পরিপাক ক্রিয়া বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ফলসার অন্যান্য উপকারিতা
ফলসায় উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান একে নানান প্রদাহজনিত সমস্যার উপশমে উপযোগী করে তোলে। বিশেষ করে পেটের আলসার এবং অন্যান্য গরমজনিত সমস্যাতে এর পেট ঠান্ডা করার ক্ষমতা খুবই উল্লেখযোগ্য । ফলসার মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উপস্থিতি এর স্বাস্থ্যবর্ধক খ্যাতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে এবং সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ফলসা দারুণ কাজ করে।
পেটের সমস্যা ছাড়াও, ফলসা আরও নানারকম অসুস্থতা কমাতে সাহায্য করে। এতে উচ্চ আয়রন বা লোহার উপস্থিতির জন্য রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়াতে খুব কাজ দেয় । শ্বাসনালীর বিভিন্ন সমস্যা যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা অ্যাজমাতেও ফালসার রস খুব উপকারী বলে মনে করা হয়।
এক ঝলকে ফলসায় থাকা বিভিন্ন উপাদান এবং তা আমাদের শরীরের কী উপকারে লাগে
উপাদান | উপকারিতা |
---|---|
ভিটামিন সি | ইমিউন সিস্টেম বাড়ায়, ত্বকের সুস্থতা রক্ষা করে এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। |
ফাইবার | হজম শক্তি বাড়ায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং পেট স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। |
আয়রন | রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায় এবং অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে। |
ক্যালসিয়াম | হাড়ের স্বাস্থ্য বাড়ায় এবং দাঁতের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। |
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান | প্রদাহজনিত রোগগুলির উপশম করে এবং শরীরের প্রদাহ কমায়। |
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট | শরীরের কোষগুলিকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং বার্ধক্য প্রতিরোধ করে। |
মিনারেলস | সামগ্রিক মেটাবলিজম এবং শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। |
আজকাল প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ সারানোর প্রবণতা বেড়েছে, তাই ফলসার মতো ঐতিহ্যবাহী ফলের চাহিদাও বাড়ছে। এর নানা স্বাস্থ্যগুণ নিয়ে নিয়মিত গবেষণা চলছে, আর তাতে বারংবার প্রমাণিত হচ্ছে যে বহু সংস্কৃতিতে বহু বছর ধরে যা জানা ছিল, বিজ্ঞানও আজ তাই বলছে। ফলসা কেবল একটা ফল নয়; এই ছোট্ট টক ফলের মধ্যে লুকিয়ে আছে স্বাস্থ্যের ভাণ্ডার। সরাসরি, রস করে, বা এমনকি রোজকার খাবারের সাথেও ফলসা খাওয়া যায় – যেভাবেই খাওয়া হোক, স্বাস্থ্য রক্ষায় ফলসা এক অনন্য স্থানের অধিকারী।