বাজারে গেলে সকলেই আগে খোঁজ করে ধপধপে সাদা চিকন চাল । এর ভাত দেখতে অনেক সুন্দর ঝরঝরে । কিন্তু এই ধপধপে সাদা চিকন চাল কিন্তু তার প্রক্রিয়াকরণের পথে হারিয়ে ফেলে অনেক পুষ্টিগুণ । তুলনায় অস্বচ্ছ ঢেঁকি ছাটা চাল অনেক পুষ্টিকর । তবে এসবের চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টি আছে যে চালে তা কিন্তু সাদা নয় বরং কালো কিংবা বলা যায় গাঢ় বেগুনি চাল । একটা সময় এই চাল কেবলমাত্র অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও আজকাল তা সাধারণের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে । এর এই জনপ্রিয়তার প্রধাণ কারণ এর পুষ্টিগুণ ।
একসময় কালো চালকে বলা হত ‘নিষিদ্ধ চাল’। কারণ এর দুষ্প্রাপ্যতা আর পুষ্টিগুণের জন্য কালো চাল শুধুমাত্র চীনের রাজপরিবারের জন্য সংরক্ষিত ছিল। তবে আজ সারা বিশ্বেই কালো চালের স্বাদ আর উপকারিতা সমাদৃত।
বিশ্বজুড়ে নানা জাতের কালো চাল রয়েছে, প্রতিটির স্বাদ, গন্ধ, এবং উপকারিতায় রয়েছে ভিন্নতা। ইন্দোনেশিয়ার কালো চাল মিষ্টি স্বাদের জন্য পরিচিত, থাইল্যান্ডের জেসমিন কালো চাল সুগন্ধি, আর ফিলিপাইনের বালাতিনাও চাল স্বাদ ও পুষ্টিগুণে অনন্য। ভারতের মণিপুর ও তামিলনাড়ুতেও রয়েছে কালো চালের আলাদা জাত। বাংলাদেশে ‘কালো ধানের চাল’ নামে পরিচিত এই চাল পোলাও থেকে শুরু করে নানা মিষ্টিতে ব্যবহৃত হয়।
অনন্য পুষ্টিগুণ:
কালো চালের পুষ্টিগুণের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে অ্যান্থোসায়ানিনের নাম। এই উপাদানটিই কালো চালের গাঢ় বেগুনি-কালো রঙের জন্য দায়ী। শক্তিশালী এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের কোষের ক্ষয় রোধ করে, প্রদাহ কমায়, এমনকি হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমাতে সাহায্য করে।
বাদামী চালের সমপরিমাণ ফাইবার রয়েছে কালো চালে। এই ফাইবার হজমের জন্য অত্যন্ত উপকারী, রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে, এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে, ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
এছাড়াও কালো চালে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিন, যা পেশির সুস্থতা এবং বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়। আয়রন, ভিটামিন ই, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস সহ আরও অনেক প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানে ভরপুর কালো চাল।
স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী:
কালো চালের স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিসীম। ব্লুবেরি সহ অন্যান্য বেরি জাতীয় ফলের চেয়েও বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে বলে আর্থ্রাইটিস, হাঁপানি সহ নানা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
কালো চালের ফাইবার হজমশক্তি বাড়ায়, কোলেস্টেরল কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, এবং হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখে। এছাড়াও রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে বলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। সাদা চালের মতো রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বাড়িয়ে দেয় না, বরং ধীরে ধীরে শর্করা নিঃসরণ করে।
রান্নায় নানা ব্যবহার:
স্বাদের দিক দিয়েও কালো চাল অনন্য। এর স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো, গন্ধেও রয়েছে মিষ্টি আভাস। পুডিং, পোলাও, কেক, এমনকি নুডলস ও বান তৈরিতেও কালো চাল ব্যবহার করা হয়। সকালের ব্রেকফাস্টে কালো চালের পায়েস বা ওটস খেতেও দারুণ লাগে।
সাদা চালের চেয়ে কেন এগিয়ে:
সাদা চালের তুলনায় কালো চালে রয়েছে অনেক বেশি ফাইবার, প্রোটিন, ভিটামিন, এবং খনিজ উপাদান। সাদা চালের প্রায় সব পুষ্টিগুণই নষ্ট হয়ে যায় প্রক্রিয়াজাতকরণের সময়। ফলে, স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে কালো চাল সাদা চালের থেকে অনেক এগিয়ে।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, কালো চাল নিয়মিত খেলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও অনেক কমে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি, এবং অ্যান্টি-ডায়াবেটিক উপাদানে ভরপুর কালো চাল সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।
উপাদান | পরিমাণ (প্রতি ১০০ গ্রাম) | গুরুত্ব |
---|---|---|
কার্বোহাইড্রেট | ৫৭.৪ গ্রাম | শরীরের প্রধান শক্তির উৎস, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বজায় রাখে, পেশী ও কোষের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। |
প্রোটিন | ১০.৩ গ্রাম | পেশীর বৃদ্ধি ও মেরামতের জন্য অপরিহার্য, কোষের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। |
ফাইবার | ৭.৬ গ্রাম | হজমশক্তি উন্নত করে, কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। |
ফ্যাট | ৪.৩ গ্রাম | শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ভিটামিন শোষণে সহায়তা করে, হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করে। |
আয়রন | ৫.১ মিলিগ্রাম | লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে সাহায্য করে, অক্সিজেন পরিবহনে সাহায্য করে, রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। |
ম্যাগনেসিয়াম | ৮৩ মিলিগ্রাম | পেশীর কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। |
ফসফরাস | ২১৩ মিলিগ্রাম | হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, শক্তির উৎপাদনে সাহায্য করে, কিডনির কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। |
জিঙ্ক | ১.৫ মিলিগ্রাম | রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, কোষের বৃদ্ধি ও মেরামতে সাহায্য করে, |
ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) | ০.৪ মিলিগ্রাম | শরীরে শক্তির উৎপাদনে সাহায্য করে, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে। |
ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লাভিন) | ০.০৪ মিলিগ্রাম | শরীরে কোষের বৃদ্ধি ও মেরামতে সাহায্য করে, দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে, ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। |
ভিটামিন বি৩ (নিয়াসিন) | ৫.২ মিলিগ্রাম | শরীরে শক্তির উৎপাদনে সাহায্য করে, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। |
ভিটামিন বি৫ (প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড) | ০.৫ মিলিগ্রাম | শরীরে কোষের বৃদ্ধি ও মেরামতে সাহায্য করে, হরমোন উৎপাদনে |
কালো চাল শুধু একটা খাদ্যশস্যই নয়, বরং স্বাস্থ্যের এক অমূল্য সম্পদ। এর অনন্য পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্য উপকারিতা, এবং রান্নায় বহুমুখী ব্যবহারের কারণে কালো চালকে আপনার নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় রাখতেই পারেন। তবে যেকোনো খাবারের মতোই, কালো চাল পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।