সম্প্রতি কলকাতার বেশ কিছু নামী রেস্টুরেন্টে স্বাস্থ্য দফতর হানা দিয়ে যে সব তথ্য সামনে এনেছে তা দেখলে চক্ষু চড়কগাছে ওঠার কথা । শহরের যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা বিরিয়ানির দোকানগুলিতে বিরিয়ানিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম রঙ , যেগুলি আদৌ ফুড গ্রেডের নয় !
এই কৃত্রিম রঙগুলির মধ্যে বিভিন্ন ধরণের কেমিক্যাল থাকতে পারে, যেমন মেটালিক সল্ট, নিউরোটক্সিন, এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ। এগুলি শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে।বেশ কিছু জায়গাতে দেখা গিয়েছে বিরিয়ানিতে রঙ করবার জন্য তাঁরা ব্যবহার করছেন ‘কামধেনু’ । যার গায়ে স্পষ্ট করেই লেখা আছে “FOR INDUSTRIAL USE ONLY, NOT FOR HUMAN CONSUMPTION”(শিল্পে ব্যবহারের জন্য, মানুষের খাওয়ার জন্য নয়) । এই কামধেনু রঙের মধ্যে উপস্থিত কিছু কেমিক্যাল লিভার এবং কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, এমনকি ক্যান্সারের কারণও হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থা এই ধরনের কৃত্রিম রঙের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা প্রায়শই এই রঙগুলির ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি করে থাকে এবং জনগণকে এই ধরনের খাবার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়।
কামধেনু রঙ ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য হল খাদ্যপণ্যকে আরও রঙিন ও আকর্ষণীয় করা। বিরিয়ানির মতো জনপ্রিয় খাবারে এই ধরনের রঙ যুক্ত করলে তা ভোক্তার কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। রেস্তোরাঁ মালিকরা এবং কিছু রাস্তার খাবার বিক্রেতারা এই পদ্ধতিতে উচ্চ মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করেন, যদিও তারা জানেন যে এটি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে।
তবে, এই রঙগুলি ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। খাদ্যে কামধেনু রঙ ব্যবহারের ফলে খাদ্য বিষক্রিয়া, কিডনি ও লিভারের সমস্যা, এমনকি ক্যান্সারের মতো জটিল রোগও হতে পারে। তাই, এই ধরনের অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ করা এবং ভোক্তাদের সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি।
বাজারে মূলত দুই ধরণের কামধেনু রং পাওয়া যায় হলুদ কামধেনু আর লাল কামধেনু । দুটোই স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ংকর ক্ষতিকর ।
মেটানিল ইয়েলো (C18H14N3NaO3S) একটি কৃত্রিম রঙ যা প্রধানত শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটি কামধেনুর হলুদ রঙ নামে পরিচিত এবং সাধারণত টেক্সটাইল, কাগজ, এবং পেইন্ট শিল্পে ব্যবহার করা হয়। মেটানিল ইয়েলো সাধারণত খাদ্যে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত নয়, কারণ এটি স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকি বহন করতে পারে।
মেটানিল ইয়েলো রঙটি খাবারে মেশানো হলে তা মানব দেহে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এর প্রভাবে পেটের সমস্যা, বমি, ডায়রিয়া, এবং লিভার ও কিডনির ক্ষতি হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে এটি কার্সিনোজেনিক হতে পারে, অর্থাৎ 🔎︎ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
খাদ্যে মেটানিল ইয়েলোর উপস্থিতি বিশেষত শিশুদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। শিশুদের শরীর তুলনামূলকভাবে সংবেদনশীল হওয়ায় তারা এই বিষাক্ত রঙটির প্রতি আরো ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করতে পারে।
বাজারে সস্তা এবং আকর্ষণীয় রঙের খাবার তৈরির জন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মেটানিল ইয়েলো ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষত বিরিয়ানি, মিষ্টি, এবং বিভিন্ন মুখরোচক খাবারে এই রঙটি মেশানো হয়ে থাকে, যা খাদ্যপ্রেমীদের জন্য একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি।
সুতরাং, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মেটানিল ইয়েলো এবং অনুরূপ ক্ষতিকর কৃত্রিম রঙগুলি থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। খাদ্যে প্রাকৃতিক এবং অনুমোদিত রঙের ব্যবহার স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলির উচিত যথাযথ নজরদারি এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই ধরনের বিপজ্জনক রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করা।
এস এস রেড, যা পটাসিয়াম ডাইক্রোমেট (Potassium Dichromate – K2Cr2O7) নামেও পরিচিত, হল একটি কেমিক্যাল যা মূলত শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটি রঙিন করার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এর রঙ উজ্জ্বল লাল। যদিও এটি শিল্পক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী, এটি খাবারে ব্যবহৃত হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
পটাসিয়াম ডাইক্রোমেট একটি শক্তিশালী অক্সিডাইজিং এজেন্ট যা অনেক শিল্প প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়, যেমন ট্যানিং, রং তৈরি ও ধাতু পরিষ্কার করা। এই কেমিক্যালটি খাদ্যে ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক কারণ এটি বিষাক্ত এবং কার্সিনোজেনিক। পটাসিয়াম ডাইক্রোমেটের প্রভাব খাদ্যে প্রবেশ করলে তা স্বাস্থ্যের উপর বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই কেমিক্যালটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করলে শ্বাসযন্ত্রের নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন কাশি, শ্বাসকষ্ট, এবং ফুসফুসের প্রদাহ। ত্বকের সাথে সরাসরি সংস্পর্শে এলে এটি ত্বকে জ্বালা, লালচে ভাব, এবং ডার্মাটাইটিসের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী এক্সপোজারের ফলে কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পটাসিয়াম ডাইক্রোমেট শরীরে প্রবেশ করলে তা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যেমন বমি, ডায়রিয়া, এবং পেটের ব্যথা। এছাড়াও, এটি রক্তে শোষিত হলে হেমাটোলজিকাল সমস্যার সম্ভাবনা বাড়ায়, যা রক্তস্বল্পতা ও অন্যান্য রক্তের রোগের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
অতএব, খাবারে এস এস রেড বা পটাসিয়াম ডাইক্রোমেটের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা উচিত। খাদ্যের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য এই বিষয়ে কঠোর নিয়মাবলী প্রয়োগ করা আবশ্যক।