সুগারের জন্য অনেকেই মিষ্টি খাওয়া বাদ দিয়েছেন । আসলে চিনি বেশি খেলে কেবল সুগার নয় কোলেস্টেরল এবং ব্লাড প্রেশারকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা মুস্কিল । তাই সকলেই খুঁজে চলেছেন চিনির এমন এক বিকল্প যার স্বাদ হবে মিষ্টি তবে চিনির মত স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হবে না । স্টেভিয়া হল সেই বিকল্প যা শুধু আমাদের শরীরের পক্ষে উপকারীই নয় সঙ্গে চিনির চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি ।
মূলত দক্ষিণ আমেরিকাতে এর বিপুল প্রচলন থাকলেও আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই এটির প্রচলন ছিল । আমারা এই গাছটিকে মিষ্টি তুলসী নামে চিনি । ভারতীয় আয়ুষ মন্ত্রক এই গাছটিকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহারের জন্য স্বীকৃতি দিয়েছে অনেক আগেই ।
স্টেভিয়া বা মিষ্টি তুলসী আসলে ‘Stevia rebaudiana’ গাছের পাতা থেকে প্রাপ্ত একটা প্রাকৃতিক মিষ্টি । চিনি বা কৃত্রিম মিষ্টির মতো ক্ষতিকর কিছু না বরং ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম ।
🌿স্টেভিয়া কীভাবে ডায়াবেটিস , কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে?
⚕️ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে স্টেভিয়া
ডায়াবেটিস যাদের আছে, তাদের জন্য স্টেভিয়ার সবচেয়ে বড় উপকার হলো এটা রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়। স্টেভিয়ার মধ্যে steviol glycosides নামে কিছু উপাদান আছে, যেমন stevioside আর rebaudioside A- এগুলোই স্টেভিয়ার মিষ্টত্বের জন্য দায়ী । এই উপাদানগুলো শরীরের ভেতর চিনির মতো কাজ করে না, মানে এগুলো খেলে রক্তে শর্করা বাড়ে না।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্টেভিয়া খেলে রক্তের শর্করার মাত্র কমে। এমনকি একটা গবেষণায় দেখা গেছে স্টেভিয়া রক্তের শর্করা শুধু কমায় না সাথে ইনসুলিনকেও প্রভাবিত করে । ইনসুলিন হল একপ্রকারের হরমোন যা রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। যাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে, তাদের জন্য এই ইনসুলিনের কাজ ঠিক রাখাটা অত্যন্ত জরুরি।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো,চিনি খেলে আমাদের শরীর ঠিক যেমন প্রতিক্রিয়া দেয় স্টেভিয়া খেলেও শরীর একই রকম প্রতিক্রিয়া দেয় কিন্তু পার্থক্য হল চিনিতে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায় আর স্টেভিয়াতে বাড়েনা । এর ফলে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নির্গত হয়, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
🩸 উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে স্টেভিয়া
স্টেভিয়া শুধু ডায়াবেটিস নয়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনের জন্যও দারুণ উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্টেভিয়ার উপাদানগুলো রক্তনালীকে প্রশস্ত করে দেয় এবং পাশাপাশি শরীর থেকে বাড়তি জল নির্গমন করে বের করে দেয়। ফলে রক্তের পরিমাণ কমে , রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং রক্তচাপও কমে যায়।
🩺 কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে স্টেভিয়া
স্টেভিয়া শুধু রক্তচাপ আর শর্করাই নয়, কোলেস্টেরলও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্টেভিয়া খেলে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) আর ট্রাইগ্লিসারাইড কমে যায়, আর ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ে। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক কমে যায় ।
স্টেভিয়া আসলে কিভাবে কোলেস্টেরল কমায়, সেটা এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, স্টেভিয়াতে যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে, সেটাই কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
উপাদান | স্বাস্থ্য উপকারিতা |
---|---|
স্টিভিওসাইড | রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, ডায়াবেটিসে সহায়ক। |
রেবাউডিওসাইড এ | রক্তের চিনির মাত্রা কমাতে সহায়ক। |
অন্যান্য স্টিভিওল গ্লাইকোসাইডস | রক্তের চিনির মাত্রা কমানোর সঙ্গে সঙ্গে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়। |
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট | কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে, এবং রক্তনালীর ক্ষতি প্রতিরোধ করে। |
প্রোবায়োটিকস | অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নতি করে, যা মেটাবোলিক হেলথ ভালো রাখে। |
খনিজ (পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম) | পটাশিয়াম হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। |
স্টেভিয়া কেন একটা ভালো বিকল্প?
স্টেভিয়াতে কোনো ক্যালরি নেই। এজন্য যারা ওজন কমাতে চান বা ডায়েট করছেন, তাদের জন্য স্টেভিয়া খুবই ভালো একটা বিকল্প। এটা প্রাকৃতিক মিষ্টি, তাই কৃত্রিম মিষ্টি বা বেশি চিনি খাওয়ার মতো কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
আর স্টেভিয়া যেকোনো তাপমাত্রায়, যেকোনো অবস্থায় একই রকম থাকে। তাই রান্না বা বেকিংয়ে স্টেভিয়া খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। অন্যান্য কিছু মিষ্টি আছে যেগুলো বেশি তাপ দিলে নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু স্টেভিয়ার সেই সমস্যা নেই।
কীভাবে খাওয়া যায় স্টেভিয়া
স্টেভিয়া একটি প্রাকৃতিক মিষ্টি যা চিনি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়,তাই চিনি যে সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় সেই সমস্ত ক্ষেত্রে স্টেভিয়া ব্যবহার করা চলে । তবে চিনির চেয়ে যেহেতু বহুগুণ মিষ্টি তাই ব্যবহারের সময় এর পরিমাণ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে ।
স্টেভিয়ার গন্ধ কাটাবে কীভাবে
স্টেভিয়ার প্রাকৃতিক মিষ্টি স্বাদ অনেকের কাছে পছন্দ হলেও, এর বিশেষ গন্ধ বা আফটারটেস্ট কিছু মানুষ অপছন্দ করতে পারেন। স্টেভিয়ার গন্ধ কাটানোর কিছু উপায় নিচে দেওয়া হলো:
- লেবুর রস: স্টেভিয়ার সঙ্গে কিছুটা লেবুর রস মেশালে গন্ধ কমে যায় এবং টেস্ট ভালো হয়।
- ভ্যানিলা এক্সট্রাক্ট: ভ্যানিলা এক্সট্রাক্ট মিশিয়ে দেখা যেতে পারে । এটি স্টেভিয়ার গন্ধ কমাতে সাহায্য করে এবং খাবারে সুন্দর সুবাস যোগ করে।
- সিনামন বা দারুচিনি: দারুচিনি গুঁড়ো ব্যবহার করে দেখা যেতে পারে, যা স্টেভিয়ার গন্ধকে ঢেকে দিতে সাহায্য করে।
- ফলের রস: ফলের রস (যেমন, কমলা বা আপেলের রস) মেশালে গন্ধ কমে যায় এবং স্বাদ উন্নত হয়।
- কোকো পাউডার: বিশেষ করে মিষ্টান্ন বা বেকিংয়ের ক্ষেত্রে, কোকো পাউডার মেশালে স্টেভিয়ার গন্ধ কমে যায়।
- মৌরি বা মিন্ট: মৌরি বা মিন্টের পাতা মিশিয়ে দেখা যেতে পারে । এদের সুবাস স্টেভিয়ার গন্ধকে ঢেকে দিতে পারে।
- সঠিক পরিমাণ ব্যবহার: স্টেভিয়া অনেক বেশি মিষ্টি, তাই প্রয়োজনের চেয়ে কম ব্যবহার করার চেষ্টা করা উচিৎ। কম ব্যবহার করলে গন্ধ কম অনুভূত হয়।