‘তিল’কে বলা হয় ‘সুপারফুড’। ‘সুপারফুড’ হল সেই খাবার যা অল্প পরিমাণ খেলেও শরীরের অনেক উপকার করে। আমাদের দেশজ এই ক্ষুদ্র দানা শস্যের মধ্যে যে কি অসাধারণ সব বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে তা জানলে অবাক হতে হয় – পুষ্টি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং উপকারী ফ্যাটের ভান্ডার বলতে যা বোঝায় তিল হল তাই । হাজার হাজার বছর ধরে তিলকে রান্না-বান্না থেকে শুরু করে নানা রকম ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়ে আসছে। আমাদের দেশে সাধারণত দু ধরণের তিল পাওয়া যায় – কালো আর সাদা। দুটোই শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী।
তিলের পুষ্টিগুণ
কালো তিল:
কালো তিল তার অসাধারণ পুষ্টিগুণের জন্য সবার মধ্যে বেশি পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে:
- ক্যালসিয়াম: যা আমাদের হাড় মজবুত রাখতে এবং অস্টিওপরোসিসের মতো রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
- আয়রন: যা রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে এবং শরীরকে সারাদিন চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে।
- জিঙ্ক: যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখে।
- ম্যাগনেসিয়াম: যা মাংসপেশি ও স্নায়ুর কাজ ঠিক রাখে, রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে।
- ভিটামিন বি: যা শরীরে শক্তির জোগান দেয় এবং মস্তিষ্ক সুস্থ রাখে।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: কালো তিলে লিগন্যান নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে, যা শরীরের প্রদাহ কমায় এবং নানা ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
সাদা তিল:
সাদা তিলের পুষ্টিগুণ কালো তিলের থেকে কিছুটা আলাদা হলেও, এটি কিন্তু কম উপকারী নয়। এর মধ্যে আছে:
- প্রোটিন: নিরামিষভোজীদের জন্য সাদা তিল দারুণ প্রোটিনের উৎস।
- স্বাস্থ্যকর ফ্যাট: এই ফ্যাটগুলো শরীরের জন্য ভালো। এগুলো কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখতে এবং হৃদপিণ্ড ভালো রাখতে সাহায্য করে।
- ফাইবার: যা হজমে সাহায্য করে, পেট পরিষ্কার রাখে এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ ঠিক রাখে।
- ভিটামিন এবং মিনারেল: সাদা তিলেও ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাস আছে, যা হাড়ের সুস্থতায় এবং শরীরের নানা কাজ ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
তিলের উপকারিতা
- হাড়ের সুস্থতা: তিলে ক্যালসিয়াম আর ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ বেশি, যা হাড় এবং দাঁত মজবুত রাখতে খুবই জরুরি। নিয়মিত তিল খেলে হাড়ের ক্ষয়রোধ হয় এবং অস্টিওপরোসিসের মতো অসুখ থেকে দূরে থাকা যায়। এটা বিশেষ করে মেনোপজের পর মহিলাদের জন্য খুবই উপকারী।
- হৃদপিণ্ডের সুস্থতা: তিলে থাকা স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, বিশেষ করে পলিআনস্যাচুরেটেড এবং মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, হৃদপিণ্ডের জন্য খুবই উপকারী। এগুলো খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল বাড়ায়, ফলে হার্টের নানা রকম অসুখের ঝুঁকি কমে। এছাড়াও, তিলে থাকা লিগন্যান এবং ফাইটোস্টেরল নামের উপাদানগুলো রক্তচাপ কমায় এবং হার্টের রক্তনালীগুলো ঠিক রাখে।
- পাচনতন্ত্রের সুস্থতা: তিলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা হজমের জন্য খুবই দরকারি। ফাইবার পেট পরিষ্কার রাখে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিসের রোগী এবং যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য তিল খুবই উপকারী।
- ত্বক এবং চুলের সুস্থতা: তিলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বক এবং চুল সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এগুলো ত্বকে যেকোনো প্রদাহ কমায়, ত্বক টানটান রাখে এবং বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। তিলের তেল ত্বকের ময়েশ্চারাইজার হিসেবে এবং চুলের যত্নেও ব্যবহৃত হয়। এটি চুলের বৃদ্ধি বাড়ায় এবং মাথার ত্বকের শুষ্কতা দূর করে।
- প্রদাহরোধী এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: কালো এবং সাদা, দুই ধরনের তিলেরই প্রদাহ কমানোর এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান রয়েছে। এগুলো শরীরে যেকোনো প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, যা আর্থ্রাইটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য উপকারী। তিলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের কোষের ক্ষতি রোধ করে, ক্যান্সার এবং হার্টের অসুখের ঝুঁকি কমায়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: তিলে থাকা জিঙ্ক এবং সেলেনিয়াম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধকারী কোষের বৃদ্ধি এবং কাজের জন্য জরুরি। অন্যদিকে, সেলেনিয়াম শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
কালো তিল একটু বেশি উপকারী কেন?
দুই ধরনের তিলই খুব পুষ্টিকর হলেও, বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় কালো তিল একটু এগিয়ে। সেসামিন এবং সেসামোলিনের মতো শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় কালো তিল শরীরের ক্ষয়রোধ এবং প্রদাহ কমাতে বেশি কার্যকরী। ফলে সার্বিক সুস্থতা বজায় রাখতে এবং দীর্ঘায়ু লাভে কালো তিলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এছাড়াও, কালো তিল চুল কালো রাখতে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং লিভারের সুস্থতা বজায় রাখতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে।
কালো তিল পছন্দ করুন বা সাদা, নিয়মিত তিল খেলে এর উপকারিতা পাবেনই। তিলের পুষ্টিগুণ এবং নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য একে সত্যিকার অর্থেই “সুপারফুড” বলা যায়। কালো এবং সাদা, কোন তিল বেশি উপকারী সেটা আসলে আপনার পছন্দ এবং আপনার শরীরের চাহিদার ওপর নির্ভর করে। তবে দুটোর যেকোনো একটা নিয়মিত খেলে আপনার স্বাস্থ্য অনেক ভালো থাকবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।