শেষ কয়েক দশকে মুরগির মাংসের বিপুল চাহিদা মেটাতে ব্রয়লার মুরগি পালন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দ্রুত ওজন বাড়ানোর জন্য এই মুরগিগুলোর জিনগত পরিবর্তন করা হয়, ফলে বাজারের জন্য তৈরি হয় মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু সস্তা দাম আর সহজলভ্যতার আড়ালে লুকিয়ে আছে বিপদ ।
ওজন যত দ্রুত বাড়ে , সমস্যাও বাড়ে ততই দ্রুত
ব্রয়লার মুরগি, অর্থাৎ যে মুরগিগুলো শুধু মাংসের জন্য পালন করা হয়, তাদের জিনগতভাবে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে খুব দ্রুত ওজন বাড়ে – সাধারণত মাত্র ৩৫ থেকে ৩৬ দিনেই! কিন্তু, এই বৃদ্ধির হার স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নয়, আগে একটা মুরগিকে একই আকারে পৌঁছতে কয়েক মাস লেগে যেত। মুরগির শরীরের উপর কৃত্রিম এই চাপের ফলে তার নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়, যেমন হাড়ের সমস্যা, হৃদরোগ, এমনকি শ্বাসকষ্টও।
মাত্রতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ডেকে আনছে বড় বিপদ
দ্রুত বৃদ্ধি এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগের প্রকোপ ঠেকাতে, ব্রয়লার মুরগিদের নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। এই অ্যান্টিবায়োটিক দুটি কাজ করে- রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি মুরগির ওজনও দ্রুত বাড়ায়। কিন্তু, নিয়ন্ত্রণের বাইরে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের ফলে বাড়ছে বিশ্বব্যাপী বিপদ , বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে জীবাণুগুলোর প্রতিরোধ ক্ষমতা।
ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়ার সময় আমাদের শরীরে অল্প পরিমাণে হলেও এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ঢুকে যায়। এর ফলে আমাদের শরীরেও অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে পারে। ফলে সাধারণ ইনফেকশনেও কাজ না করার মতো ঝুঁকি তৈরি হয়। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে আমাদের রাজ্যে একটা বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে যেটা ভীষণই বিপদের । যদি আপনার শরীরে এন্টিবায়োটিক কাজ করা বন্ধ করে দেয়ে তবে সামান্য পেট ব্যথাও আপনার জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যেই এরকম অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আগামীর মানবজাতীর জন্য শীর্ষ দশ বিপদদের একটি বলে চিহ্নিত করেছে।
অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াও ব্রয়লার মুরগিতে ই.কোলাই, সালমোনেলা, ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার-সহ নানা পরজীবী থাকতে পারে, যা থেকে মানুষের খাবারে বিষক্রিয়া হতে পারে। মুরগি কাটার সময় মাংসে এই জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে, আর মাংস ভালোভাবে না সেদ্ধ করলে পেটের গোলমাল, এমনকি আরও নানা স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দিতে পারে। রান্নাঘরে এই জীবাণু অন্য খাবারে বা তৈজসপত্রে ছড়িয়ে পড়ারও ঝুঁকি থাকে।
ব্রয়লার মুরগির চাষের জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে মুরগিগুলোকে রাখা হয়, যেখানে ঠোকরানো, মাটি খুঁচিয়ে খাবার খোঁজা, এমনকি ডানা মেলা পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এতে শুধু মুরগিরাই কষ্ট পায় না, এরকম চাষ পদ্ধতির পরিবেশগত প্রভাবও ভাবনার বিষয়। মুরগির চাহিদা পূরণ করতে বনজঙ্গল উজাড়, জলাভূমির দূষণ, এমনকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে – এসবই বৈশ্বিক সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ব্রয়লার মুরগির মাংস নিয়ে উদ্বেগের তাই যথেষ্ট কারন আছে । কিছু বিকল্প পদ্ধতি আছে যার মাধ্যমে এই ঝুঁকিগুলো কমানো যায়; যেমন জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা , মত্রাতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা ।
ব্রয়লার মুরগির বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে, কিন্তু ভোক্তা হিসেবে আমাদের হাতেও কিছু করার আছে। আমরা কি করতে পারি ?
- জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাংস খোঁজা: জৈব মুরগি পালনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং মুরগিগুলোকে খোলামেলা পরিবেশে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। যদিও জৈব মুরগির মাংস একটু দামি, তবে স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর প্রভাবের দিক থেকে এই বিকল্প বেশি উপযোগী।
- দেশী মুরগী: দেশী মুরগী বা স্থানীয়ভাবে মুরগি উৎপাদনকারী খামারগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা উচিত যেখানকার মান বজায় রাখার উপর নির্ভর করতে পারেন। এতে নৈতিক মান বজায় রাখা সহজ হয় এবং সরবরাহের পথও অনেক ছোট হয় – ফলে খাবারটি বেশি তাজা হয়।
- মাংস খাওয়া কমানো: সপ্তাহে কয়েকদিন মাংসের বদলে উদ্ভিজ্জ আমিষ খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, এর সাথে পরিবেশগত প্রভাবও ইতিবাচক। শাকসবজি, ডাল, বাদাম ইত্যাদিতে প্রচুর আমিষ থাকে, সুষম খাদ্যের ক্ষেত্রে মাংসের পুরোপুরি বিকল্প হতে পারে এগুলো।