কলকাতার রাস্তায়, গলির মোড়ে, আর পুরোনো পাড়ায় ‘বিরিয়ানি’ নামটা উচ্চারণ করলেই যেন চোখেমুখে এক আলাদা চমক! কলকাতা যেন নিজের বিরিয়ানি নিয়ে বড্ড আপন – নিজামের বিরিয়ানি সেরা, নাকি আরসালান, নাকি রয়াল, নাকি আমিনিয়া? আড্ডার মজলিসে এই নিয়ে তর্ক লেগেই থাকে। কিন্তু এই তর্কটাই যেন আসল মজা! লম্বা চালের ভাত, ঘিয়ে চকচকে, মাংসের টুকরো নরম, সিদ্ধ ডিমের ঝলক আর সবার শেষে সেই হলদেটে আলু – এই তো কলকাতার বিরিয়ানির খাস পরিচয়, অন্য কোথাও মিলবেই না!
বিরিয়ানির খোঁজে…
ভারতবর্ষে বিরিয়ানির আগমন যেন এক রহস্যময় ইতিহাস। কেউ বলে, ১৩৯৮ সালে তৈমুরই নাকি এই বিরিয়ানিকে নিয়ে এসেছিলেন। বড় মাটির হাঁড়িতে সব উপকরণ ভরে, মুখ আটকে আগুনে পুঁতে রান্না হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার কারও মতে, আরব বণিকরাই বিরিয়ানি রেসিপি নিয়ে এসেছিলেন ভারতের উপকূলে, বিশেষ করে মালাবার অঞ্চলে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটা কিন্তু মুঘল সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলকে নিয়েই। মুঘল সৈন্যদের দুর্বল দেহ দেখে নাকি মমতাজ নিজেই রাঁধুনিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন চাল আর মাংস একসাথে রান্না করে এক পুষ্টিকর খাবার বানাতে। সেখান থেকেই নাকি বিরিয়ানির জন্ম!
বিরিয়ানিতে আলু কীভাবে এল ?
কলকাতার বিরিয়ানিতে আলুর ব্যবহার একদম আলাদা ব্যাপার, আর অন্য রাজ্য থেকে যারা আসেন তাদের চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! এই আলু দেওয়ার পেছনে রয়েছে এক দারুণ ইতিহাস। আওধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ যখন কলকাতায় নির্বাসিত হলেন, আর্থিক টানাপড়েনে রাজকীয় রান্নাতেও পরিবর্তন আনতে হয়েছিল। কম খরচে বেশি লোকের পেট ভরাতে মাংসের সাথে আলু যোগ করে দেওয়া হলো। স্বাদের সাথে সাশ্রয় – এই মেলবন্ধন থেকেই জন্ম নিল কলকাতার আলু দেওয়া বিরিয়ানির!
প্রচলিত ধারণা হল বিরিয়ানি একসময় শুধুই অভিজাতদের খাবার ছিল। কিন্তু, আসল বিরিয়ানি কিন্তু শ্রমিকদের পেট ভরাতেই তৈরি হয়েছিল! নবাব আসাফ-উদ-দৌলা নাকি হাজার হাজার মজুরের জন্য এমন এক পাত্রেই রান্না করা খাবারের কথা ভেবেছিলেন যাতে শ্রমিকরা তাড়াতাড়ি খেয়ে কাজে ফিরতে পারে।
বিরিয়ানির হাড়ি লাল কাপড়ে মোড়া থাকে কেন?
ইতিহাস বলছে, সম্রাট হুমায়ুন ছিলেন পারস্য সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। রাজপাঠ হারিয়ে সম্রাট হুমায়ুন ইরানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন তাঁকে পারস্য সম্রাট লাল গালিচা বা রেড কার্পেটে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এছাড়া ইরানের খাদ্য পরিবেশনার রীতি অনুযায়ী, রুপার পাত্রে খাবার আনা হয় লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে। যা পরে মোঘল আমলেও চালু হয়েছিল। খাদ্য পরিবেশনে রঙের এ প্রথা লখনৌয়ের নবাবরাও অনুসরণ করেছিলেন। ফলে অভিজাত্য, বনেদিয়ানা প্রকাশের অন্যতম ধারা হিসেবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে লাল কাপড়ে মোড়া খাবার। আজ বিরিয়ানি সহজলভ্য হলেও, এক সময় কিন্তু ছিল আভিজাত্যেরই প্রতীক। তাই ব্যবহৃত হয় লাল কাপড়।
নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর উত্তরাধিকার, সেই নরম মাংস, সুগন্ধি চাল, আর বিখ্যাত আলু – কলকাতাবাসীর মন জয় করে রেখেছে। শহরের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের নিদর্শন এই বিরিয়ানি, যেখানে প্রতি চামচেই যেন মিশে আছে এক একটা গল্প। কলকাতায় বিরিয়ানি শুধু খাবার নয়, একটা আবেগ, ঐতিহ্য এবং অসাধারণ স্বাদের লাল রঙে মোড়ানো।