আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন পারস্যের মরুভূমির বুকে খাদ্য সংরক্ষণ এবং মরুভূমির ভয়ংকর গরমে জল ঠান্ডা রাখার মত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে একটি চমৎকার স্থাপত্যরীতির উদ্ভব হয়েছিল। এই প্রাচীন আশ্চর্যটি ‘যখচাল’ (Yakhchāl) নামে পরিচিত, যার পারস্য ভাষায় আক্ষরিক অর্থ “বরফের গর্ত”।
যখচাল হলো এক ধরণের প্রাচীন রেফ্রিজারেশন পদ্ধতি যেখানে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের অনেক আগে বরফ এবং খাবার সংরক্ষণ করা হতো। প্রায় ৪০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই স্থাপত্যরীতির উদ্ভব হয়েছিল, যেটি প্রাচীন পারসিয়ানদের প্রকৌশল এবং ইনসুলেশন কৌশল সম্পর্কে অ্যাডভান্সড ধারণা দেয় ।
![আড়াই হাজার বছর আগেই গরমে পার্সিয়ানরা ব্যবহার করত ফ্রিজ 2 ইরানের যখচাল](https://thebengalexpress.news/wp-content/uploads/2024/04/yakhchal-in-yazd-iran.jpg)
যখচালগুলো সাধারণত প্রায় ৬০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতো এবং উপরে একটি বিশাল গম্বুজাকৃতির কাঠামো থাকতো, যার নীচে একটি বড় আন্ডারগ্রাউন্ড স্টোরেজ স্পেস থাকতো। এই কাঠামোগুলো বেশ বড় আকারের হতো– কিছু বৃহত্তম যখচালের আয়তন ছিল প্রায় ৬,৫০০ ঘন গজের মতো। একটি যখচাল নির্মাণে নির্দিষ্ট নির্মাণ সামগ্রী এবং নির্মাণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো, যেগুলো যখচালের দক্ষতা এবং কার্যকারিতার মূল চাবিকাঠি ছিল।
যখচাল তৈরি করা হতো সারুজ নামে একটি বিশেষ ধরণের মর্টার দিয়ে। এই মর্টার তৈরিতে ব্যবহার করা হতো বালি, কাদামাটি, ডিমের সাদা অংশ, চুন, ছাগলের লোম এবং ছাই। এগুলোর মিশ্রণ ছিল নিখুঁত, যা দেয়ালগুলোকে তাপ প্রতিরোধী এবং ওয়াটারপ্রুফ করতো। ফলে এগুলো যখচালের ভেতরের অংশকে ঠান্ডা রাখতে খুবই ভালো ইনসুলেটর হিসেবে কাজ করতো। গম্বুজের শঙ্কু আকৃতি কুলিং প্রসেসকে আরও ত্বরান্বিত করতো; তাপের ফ্লোকে উপরের দিকে পাঠিয়ে স্টোরেজ এর নীচের অংশকে ঠান্ডা রাখতো।
![আড়াই হাজার বছর আগেই গরমে পার্সিয়ানরা ব্যবহার করত ফ্রিজ 3 যখচালের ভিতরের দৃশ্য ।](https://thebengalexpress.news/wp-content/uploads/2024/04/388.jpg)
যখচালের ভেতরে একটি গভীর এবং বড় আন্ডারগ্রাউন্ড স্পেস মূল স্টোরেজ এরিয়া হিসেবে ব্যবহার হতো। সেখানে শীতকালে কাছাকাছি পাহাড় বা হিমায়িত নদী থেকে কেটে নিয়ে আনা বরফ রাখা হতো। আশ্চর্যজনকভাবে, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রার মধ্যেও এই বরফ সারা গরমকাল পর্যন্ত জমে থাকতো। এটি যখচালের ডিজাইনের যেমন প্রমাণ দেয়, তেমনই এটি প্রমাণ করে যে যখচালগুলো কতটা কৌশলগতভাবে নির্মাণ করা হতো। এগুলো সাধারণত কোনো শহর বা অঞ্চলের উত্তরতম কোণে নির্মাণ করা হতো, যাতে এগুলো সরাসরি সূর্যালোক কম পায়।
জল ব্যবস্থাপনা ছিল যখচালের কার্যকারিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কানাত নামে পরিচিতি প্রাচীন পদ্ধতির আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যানালগুলো যখচালের ডিজাইনের সাথে জোড়া থাকত যাতে অ্যাকুইফার থেকে বরফের গর্ত পর্যন্ত জল আসতে পারে। এটি শুধু গঠনকে ঠান্ডা রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা সরবরাহই করতো না, ঠান্ডা আবহাওয়ায় বরফ তৈরির প্রক্রিয়াতেও অবদান রাখতো।
প্রাচীন পারস্য সমাজে যখচালের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্য ছিল গভীর। এটি পচনশীল খাবার সংরক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছিলো, এবং খাবার প্রিজারভেশন এবং ফালুদা তৈরিতে বরফ সরবরাহ করতো। ফালুদা হলো পারস্যের ঐতিহ্যবাহী একটি ফ্রোজেন ডেজার্ট, যেটি আধুনিক যুগের শরবতের মতো। বিভিন্ন উৎসব বা রাজকীয় ভোজে বরফ স্টোর করে রাখতে পারা এবং ব্যবহার করতে পারা ছিল বিলাসিতার নিদর্শন এবং সমৃদ্ধি ও সভ্যতার সুস্পষ্ট নির্দেশক।