পার্থেনিয়াম, যে আগাছা আমেরিকা মহাদেশ থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এখন গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ার দেশগুলোতে এর দাপট দেখে চোখ কপালে ওঠারই কথা। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি, এমনকি আমাদের আপন পরিবেশকেও এ যেন এক ভয়ঙ্কর থাবায় গ্রাস করে নিচ্ছে এই ভয়ংকর আগাছা । কেবল আমাদের চারপাশের ইকোসিস্টেমকে নষ্ট করাই নয় , এমন বহু রোগ আছে যার মূল হোতা এই পার্থেনিয়াম ।
এই আগাছাটির ভয়াবহতা প্রধানত এর শরীরে থাকা কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান, যেমন পার্থেনিন এবং অন্যান্য সিসকিউটারপিন ল্যাকটোনের জন্য। এরা মিলেমিশে আমাদের শরীরের উপর যে বিষ ছড়ায়, তার ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ।
চর্মরোগ:
- একবার পার্থেনিয়ামের পাতার স্পর্শ খালি চামড়ায় লাগলেই চামড়ায় লালচে ভাব, প্রচণ্ড চুলকানি, এমনকি ফোসকা পর্যন্ত পড়তে পারে। যারা কৃষিকাজ করেন, রোদে পুড়ে মাঠে কাজ করেন, তাদের জন্য তো এ যেন এক নিত্য যন্ত্রণা।
- সরাসরি ছুঁয়ে না দেখলেও চিন্তার কিছু নেই ভাবলে ভুল হবে । বাতাসে ভেসে বেড়ানো এই আগাছার অদৃশ্য কণাগুলো ত্বকে এসে লেগে যেতে পারে যেকোনো সময়, আর তখন শুরু হবে চুলকানির মহাযজ্ঞ!
শ্বাসকষ্ট:
- যাদের আগে থেকেই হাঁপানির সমস্যা আছে, তাদের জন্য পার্থেনিয়াম যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো। এর পরাগরেণু শ্বাসের সঙ্গে ঢুকে হাঁপানির সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। শ্বাস নিতে কষ্ট, বুকে ব্যথা, এমনকি দম বন্ধ হয়ে আসা পর্যন্ত ঘটতে পারে।
- শুধু হাঁপানি কেন, এই আগাছা ফুসফুসকেও ছাড়বে না। দীর্ঘদিন এর সংস্পর্শে থাকলে কাশি আর কফের সমস্যা যেন পিছু ছাড়বেই না ।
- হঠাৎ করেই নাক দিয়ে পানি পড়া, হাঁচি, চোখ জ্বালা করছে? বুঝতে হবে পার্থেনিয়ামের হাত লেগেছে।
পশুদেরও নিস্তার নেই:
- যেসব পশু এই আগাছা আক্রান্ত মাঠে ঘাস খেয়ে বেড়ায়, অজান্তে তাদের খাবারের সাথে মিশে যায় এই বিষ । খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া, দুর্বল হয়ে পড়া, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে এর পরিণতি।
- পশু যদি পার্থেনিয়াম আক্রান্ত মাঠে চরে থাকে সেই পশুর দুধ মাংস সবকিছুই ক্ষতির কারণ হতে পারে
পরিবেশের উপর সার্বিক প্রভাব:
পার্থেনিয়ামের বিষক্রিয়া শুধু মানুষ বা পশুপাখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের পরিবেশকেও ধীরে ধীরে ভয়ংকর ক্ষতি করে চলেছে।
- পার্থেনিয়াম মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে মাটিকে অনুর্বর করে তোলে । ফলে কৃষিকাজের জন্য মাটি অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
- এই আগাছার শিকড় মাটির গভীরে গিয়ে জল শুষে নেয়। ফলে মাটি শুষ্ক হয়ে পড়ে এবং জলের স্বল্পতা দেখা দেয়।
- দেশীয় গাছপালার জন্য যে পুষ্টি, জল, সূর্যের আলো প্রয়োজন, সেসব নিজের দখলে নিয়ে নেয় এই দানব আগাছা। ফলে দেশীয় প্রজাতিগুলো ক্ষীণ হতে হতে হারিয়ে যেতে বসেছে।
- দেশীয় গাছপালা কমে গেলে বন্যপ্রাণীরা তাদের খাদ্য ও আশ্রয় হারায়। ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ে।
পার্থেনিয়াম ধ্বংস করার উপায়
- ফুল ফোটার আগেই পার্থেনিয়ামের গাছ উপড়ে ফেলা বীজের বিস্তার রোধে সহায়ক। যদিও এটি পরিশ্রমসাধ্য কাজ, কিন্তু ছোট এলাকায় এটি বেশ কার্যকর।
- নিয়মিত গাছ কেটে দিলেও বীজ উৎপাদন কমিয়ে আনা সম্ভব।
- কিছু নির্দিষ্ট আগাছানাশক দিয়ে পার্থেনিয়াম নির্মূল করা সম্ভব। তবে পরিবেশের ক্ষতি এড়াতে সতর্কতার সঙ্গে এটি ব্যবহার করতে হবে। গ্লাইফোসেট এবং ২,৪-ডি সাধারণত ব্যবহৃত আগাছানাশক।
- গরম লবণ মিশ্রিত জলেও এই আগাছার বিনাশ সম্ভব ।
পার্থেনিয়ামের বিষাক্ত ছোবল থেকে মানুষ, পশুপাখি, এমনকি আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। এই আগাছা শুধু যে অসুখ-বিসুখ ছড়ায় তাই নয়, আমাদের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি এমনকি প্রকৃতির ভারসাম্যকেও এটি হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কৃষকের ফসল নষ্ট হচ্ছে, পশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এমনকি আমাদের খাবারের মানও হুমকির মুখে।
এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে হলে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে, প্রতিবেশীদের সচেতন করতে হবে। পার্থেনিয়াম এর নির্মূল করার কৌশলগুলো জেনে, সবাই মিলে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
মনে রাখতে হবে, পার্থেনিয়ামের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু কৃষি বিভাগ বা পরিবেশবিদদের একার নয়, এটি আমাদের সবার লড়াই। আমাদের সুন্দর পৃথিবীকে এই আগাছার হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।