আমাদের চারপাশের গাছগাছালির মধ্যে প্রকৃতি এমন আশ্চর্য সব উপাদান লুকিয়ে রেখেছে যা জানলে চমকে যেতে হয় । যজ্ঞ ডুমুর তেমনই প্রকৃতির এক আশ্চর্য দান ।
জগডুমুর বা যজ্ঞডুমুর (বৈজ্ঞানিক নাম: Ficus racemosa বা Ficus glomerata) যা Moraceae পরিবারভুক্ত। এর আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মালয়েশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া। আশ্চর্য ঔষধিগুণ সম্পন্ন এই গাছের ফল, শিকড়, পাতা, ছাল, আঠা – এই প্রত্যেকটি উপাদানই ভেষজ প্রতিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যজ্ঞ ডুমুর ফল
যজ্ঞ ডুমুর ফলের আশ্চর্যজনক স্বাস্থ্যগুণ এর মধ্যে প্রধান হল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই ফলের নিয়মিত সেবনে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। এর পাতা ও ফলের রস ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি কার্যকরী প্রাকৃতিক চিকিৎসা হিসেবে কাজ করে।
এছাড়াও, যজ্ঞ ডুমুর ফল পেটের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন অ্যাসিডিটি, আলসার এবং অন্যান্য পরিপাকতন্ত্রের অসুখ নিরাময়ে সাহায্য করে। ফলের রস অন্ত্রের মুভমেন্ট বাড়িয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং পেট পরিষ্কার রাখে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হল ত্বকের সমস্যা যেমন চুলকানি ও একজিমার চিকিৎসায় জগডুমুরের ব্যবহার। ফলের রস বা পাতার পেস্ট ত্বকে লাগালে, ত্বক মসৃণ হয় এবং সংক্রমণ কমে যায়।
এই ফল হৃদরোগ প্রতিরোধেও কার্যকর। ফলের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণ হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
যজ্ঞ ডুমুরের আঠা
যজ্ঞ ডুমুর গাছের আঠা, যেটি দেখতে দুধের মতো, প্রদাহ এবং ব্যথা কমাতে ফোলা জায়গাতে প্রয়োগ করার জন্য এর কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত পরিচিত। এই আঠার সাথে লবণ মিশিয়ে লাগালে এর উপকারিতা আরও বৃদ্ধি পায়। শুধু বাইরে ব্যবহারের জন্যই নয়, অর্শ ও ডায়রিয়ার উপসর্গ কমাতেও এই আঠা খাওয়া হয়।
যজ্ঞ ডুমুরের পাতা
আঠার পাশাপাশি যজ্ঞ ডুমুর গাছের পাতাও অত্যন্ত উপকারী। পাতা থেকে একটি থক্তহকে নির্যাস তৈরি করা হয়, যা ‘ঘনসর’ নামে পরিচিত। পাতাগুলো সেদ্ধ করে, শোধন করে ঘন করে তৈরি করা এই নির্যাস বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসায় বিশেষ কার্যকরী। কাটাছেঁড়ায় লাগালে রক্ত পড়া তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দেয়, কোনো ব্যথা ছাড়াই ক্ষত সারাতেও সাহায্য করে। পোকামাকড়ের কামড়েও লাগালে জ্বালা কমে যায় এবং বিষ ছড়াতে বাধা দেয়।
চোট-মচকে যাওয়া লাগাতে ঘনসর জলে মিশিয়ে ব্যবহার করলে ব্যথা ও ফোলা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়। ফোড়ার জন্যও এটি সমানভাবে কার্যকরী; ঘনসরের প্রলেপ প্রয়োগ করলে পুঁজ বেরিয়ে যায় ও ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। মুখের দুর্গন্ধ, মাড়ির প্রদাহ অথবা গলার ক্ষত হলেও এই নির্যাস পানিতে মিশিয়ে গড়গড়া করলে দ্রুত আরাম পাওয়া যায় ও সেরে উঠার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
তাছাড়া ঘনসরের ব্যবহার আছে স্ত্রীরোগ চিকিৎসাতেও, বিশেষ করে সাদাস্রাবজনিত সমস্যায়। জরায়ু পরিষ্কারের সমাধান হিসেবে কাজ করলে এটি সমস্যাটি নিরাময়ে সাহায্য করে। ভেতরে খাওয়ার ক্ষেত্রে, জলে গুলে হেমোপটাইসিস ও রক্ত পড়া অর্শে ঘনসর নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করা হয়।
বসন্তকালে যখন গুটিবসন্তের মত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তখন যজ্ঞ ডুমুরের পাতায় হওয়া গোল গোল গুটি গুলি দুধে ভিজিয়ে মধুর সাথে মিশিয়ে এই রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এটি এই গাছের বহুবিধ ঔষধি প্রয়োগের প্রমাণ দেয়।
এছাড়াও মধুর সাথে যজ্ঞ ডুমুরের পাতার গুঁড়ো খেলে পিত্তজনিত ব্যাধি নিরাময় হয়। এটি এই বিস্ময়কর গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে কীভাবে বিস্তৃত পরিসরে রোগ নিরাময় করা যায় তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়।
এক ঝলকে যজ্ঞ ডুমুর বা জগডুমুরের ফল, পাতা, বাকল ও আঠার উপাদান ও তার শরীরে উপকারিতা
উপাদান | বিবরণ | শরীরে উপকারিতা |
---|---|---|
ফল | ভিটামিন C, এন্টি-অক্সিডেন্ট, ফাইবার | ইমিউনিটি বৃদ্ধি, পেট পরিষ্কার, হৃদরোগ প্রতিরোধ |
পাতা | অ্যান্টি-ডায়াবেটিক উপাদান, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ | ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, প্রদাহ হ্রাস |
বাকল | ট্যানিন, ফ্লাভনয়েডস | ত্বকের রোগ, পরিপাকতন্ত্র ভালো রাখে |
আঠা | প্রাকৃতিক গ্লু, অ্যান্টি-মাইক্রোবায়াল উপাদান | ঘা নিরাময়, ত্বকের সংক্রমণ প্রতিরোধ |
তবে , যে কোনো ওষুধি ফল বা উদ্ভিদের ব্যবহার করার আগে পেশাদার চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। প্রত্যেকের শারীরিক গঠন ও চাহিদা আলাদা, তাই চিকিৎসার আগে সঠিক পরামর্শ নেওয়া জরুরি।