ঘাড় বা পিঠের কিংবা কোমরের যন্ত্রণায় কাতর অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে, শক্ত জায়গায় ঘুমালে কি আদৌ উপকার পাওয়া যায়? আমাদের দেশে প্রতি তিন জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজনেরই নিয়মিত ঘাড়ে বা কোমরে কিংবা পিঠে ব্যাথা হয়, আর এই ব্যাথার কারণে প্রায়ই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। পশ্চিমা বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলেন, মেঝেতে ঘুমালে এই ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এই দাবির পেছনে আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি?
আসলে মেঝেতে শোয়া কোনো নতুন ব্যাপার নয়। সেই প্রাচীন সভ্যতার যুগে যখন আরামদায়ক বিছানা ছিল না, তখন মানুষ মাটিতেই শুত। এমনকি আজও পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানুষ মেঝেই শুয়ে থাকেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে, মেঝেতে ঘুমালে শরীর-মন ভালো থাকে। জাপানেও অনেকেই মেঝেতে পাতলা মাদুর পেতে ঘুমান।
মেঝেতে ঘুমানোর সুবিধা কি আছে? কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যাদের বিশেষ কিছু শারীরিক সমস্যা আছে তাদের জন্য মেঝেতে ঘুমানোর কিছু সুবিধা আছে বলে মনে করা হয়। কিছু ফিজিওথেরাপিস্টের মতে, চিত হয়ে শুলে, হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে বা হাঁটু ভাঁজ করে শুলে পিঠের চাপ কমে, পিঠের পেশিগুলো আরাম পায়। এছাড়াও মেঝের কাছাকাছি তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকে বলে, ঘুমের মানও ভালো হয়।
মেঝেতে ঘুমানোর সুবিধা আসলে কী?
- মেরুদণ্ডের স্বাস্থ্য: মেঝেতে ঘুমালে মেরুদণ্ড সোজা হয়ে থাকে। নরম বিছানায় ঘুমালে শরীর অনেক সময় এবড়ো-থেবড়ো ভাবে দেবে যায়, যার ফলে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক বাঁক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই অনেকে মেঝেতে ঘুমালে পিঠের বা ঘাড়ের ব্যথা থেকে মুক্তি পান।
- রক্ত চলাচল: শক্ত জায়গায় শুলে রক্ত চলাচল ভালো হয়। অতিরিক্ত নরম বিছানার মতো শরীর কোথাও বেশি দেবে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে সারা শরীরে রক্ত চলাচল ঠিকমতো হয়।
- কোমরের ব্যথা কমে: নরম বিছানায় ঘুমালে কোমরের হাড় অনেক সময় নিচের দিকে বেঁকে যেতে পারে, যার ফলে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক অবস্থান নষ্ট হয়। মেঝেতে ঘুমালে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে অনেকের অভিজ্ঞতা।
- ঠান্ডা অনুভূতি: গরমের সময় মেঝেতে শুলে বেশ আরাম লাগে। বিছানার তুলনায় মেঝে অনেকটাই ঠান্ডা থাকে, তাই গরমে আরামের ঘুম হয়।
- মানসিক প্রশান্তি: অনেকের কাছে মেঝেতে মাদুর পেতে শোয়াটা একটা সাধারণ জীবনযাপনের প্রতীক। এতে মন শান্ত থাকে, ঘুম ভালো হয়।
কিন্তু সাবধান! মেঝেতে ঘুমানোর অসুবিধাও কম নয়:
- নরম গদির অভাব: মেঝেতে ঘুমালে শরীরের কোমর, কাঁধ, গোড়ালির মতো জায়গাগুলোতে চাপ পড়ে। এতে করে ওই জায়গাগুলোতে প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে। যাদের শরীরে হাড় বেশি, বা যারা একটু রোগা, তাদের এই সমস্যা বেশি হতে পারে।
- হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা: শক্ত জায়গায় শোলে কাঁধ, কোমরের জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে। অনেক দিন ধরে এভাবে শুলে এই ব্যথা বাড়তে পারে, আবার শরীর শক্তও হয়ে যেতে পারে।
- অ্যালার্জি: মেঝেতে ধুলোবালি, পোকামাকড় বেশি থাকে। এগুলো থেকে অ্যালার্জি হতে পারে, বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই অ্যালার্জি বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে।
- ঠান্ডা আর স্যাঁতসেঁতে ভাব: অনেক সময় মেঝেতে ঠান্ডা আর স্যাঁতসেঁতে ভাব থাকে। যাদের আগে থেকেই হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা আছে, তাদের জন্য এটা আরও কষ্টকর হতে পারে। এছাড়া, স্যাঁতসেঁতে জায়গায় শুলে সর্দি-কাশির সমস্যা হতে পারে।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা একটু কঠিন হতে পারে। নিয়মিত মাদুর আর মেঝে পরিষ্কার না করলে ধুলোবালি জমে নানা রকম অসুখ-বিসুখ হতে পারে।
মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমানোর কিছু সুবিধাও আছে, আবার কিছু অসুবিধাও আছে। সুবিধার মধ্যে আছে মেরুদণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখা, রক্ত চলাচল ঠিক রাখা, কোমরের ব্যথা কমানো, আরামের ঘুম ইত্যাদি। অসুবিধার মধ্যে আছে নরম গদির অভাব, অ্যালার্জি, ঠান্ডা লাগা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সমস্যা।
যদি মেঝেতে শুতে চান, তাহলে অবশ্যই পাতলা নয়, বরং একটু পুরু মাদুর বা যোগ ম্যাট ব্যবহার করুন। এতে শরীরের চাপ ঠিকভাবে বন্টিত হবে। এছাড়া, ঠান্ডা থেকে বাঁচতে মোটা কম্বল বা র্যাপার ব্যবহার করতে পারেন। সবচেয়ে জরুরি হলো মাদুর আর মেঝে নিয়মিত পরিষ্কার করা।
কিন্তু সবাই কি মেঝেতে ঘুমাতে পারেন? না, মোটেও না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেঝেতে ঘুমানো সবার জন্য উপকারী নয়। আমাদের মেরুদণ্ডের একটা স্বাভাবিক বাঁক আছে, যেটা মেঝের সমান্তরাল নয়। তাই, মেঝেতে শুলে মেরুদণ্ডের এই বাঁকটা ঠিকমতো সাপোর্ট পায় না, ফলে পিঠে ব্যথা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এছাড়া, নরম বিছানার মতো গদি না থাকলে কোমর, নিতম্ব, গোড়ালিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
তাহলে আগের যুগের মানুষেরা কীভাবে মাটিতে শুতেন? বিজ্ঞানীদের মতে, তাদের শরীর ছোটবেলা থেকেই এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিত। তাছাড়া, প্রাচীন যুগের মানুষেরা অনেক বেশি শারীরিক পরিশ্রম করতেন, যা তাদের পিঠের ব্যথা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করত।
এখনকার দিনে অনেক আরামদায়ক নরম তোষক বিছানা পাওয়া গেলেও মাঝারি ধরণের খুব শক্ত নয় আবার একেবারে তলতুলে নরমও নয় এমন বিছানা মেরুদণ্ডের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। যদি আপনার পুরনো নরম বিছানা থাকে, তাহলে সেটা বদল করে নতুন বিছানা কিনুন। তাতেও যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে মেমোরি ফোমের ম্যাট্রেস ব্যবহার করে দেখতে পারেন। অনেক বিশেষজ্ঞই মেমোরি ফোমের ম্যাট্রেসকে পিঠের জন্য ভালো বলে মনে করেন।
তবে শুধু বিছানা বদল করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। সুস্থ থাকার জন্য আরও অনেক কিছু করতে হয়। নিয়মিত ব্যায়াম করা, ওজন ঠিক রাখা, কোমরের পেশী শক্তিশালী করা, সবকিছুই জরুরি।
তবে সবশেষে, সিদ্ধান্ত আপনার। আপনার শরীর কী বলছে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। আপনি যদি মেঝেতে শুয়ে আরাম বোধ করেন আর কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে এটা আপনার জন্য ভালো হতে পারে। কিন্তু কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, সবার শরীর আলাদা। যা একজনের জন্য উপকারী, তা আরেকজনের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে।