ঝিঙে নয় ঝিঙের মতোই দেখতে ধুঁধুল একটা সময় আমাদের খাদ্য তালিকায় জ্বলজ্বল করত । কিন্তু আজ বাজারে গেলে ধুঁধুলের দেখাই মেলে না । তুলনামূলক ভাবে কম পরিমাণে উৎপাদন হওয়ার জন্য কৃষকরা ধুঁধুল বাদ দিয়ে অন্য সবজি চাষকে প্রধান্য দেওয়ায় প্রায় হারিয়ে যাতে বসেছে এই দেশী সবজিটি । অথচ এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অসংখ্য পুষ্টিগুণ আর নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা, যা আমাদের সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রাচীনকালে ধুঁধুলের ব্যবহার
একটা সময় প্রাচীন মিশরে ব্যপক ভাবে ধুঁধুল চাষ করা হত। সেখানে এটি শুধু খাদ্য হিসেবেই নয় বরং এর তন্তুময় কাঠামোর জন্যও মূল্যবান ছিল , এই তন্তু প্রাকৃতিক স্পঞ্জ হিসেবে ব্যবহৃত হত।
প্রাচীন চীনা চিকিৎসা পদ্ধতিতে, হাঁপানি ও ব্রংকাইটিসের মতো শ্বাসকষ্টজনিত রোগের চিকিৎসায় ধুঁধুল ব্যবহার করা হত। এছাড়াও, ধুঁধুল মায়েদের বুকের দুধ বাড়াতে এবং প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে বলে মনে করা হত।
ধুঁধুলের উপাদান
একটি মাত্র ধুঁধুলের মধ্যেই রয়েছে ভিটামিন এ, সি, ই এর মতো অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিনের সমাহার। এছাড়াও এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম সহ আরও নানা ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই সমস্ত উপাদানগুলি মিলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলে, ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে।
ওজন কমাতে ধুঁধুল
ধুঁধুলের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি গুণ হল ওজন কমানোর ক্ষেত্রে এর বিশেষ ভূমিকা। যেহেতু ধুঁধুলে ক্যালরির পরিমাণ খুবই কম (প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ২০ ক্যালরি), তাই এটি ওজন কমাতে চান এমন ব্যক্তিদের জন্য একটি আদর্শ খাবার হতে পারে। এর ফলে পরিমাণে বেশি ধুঁধুল খেলেও দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ খুব একটা বাড়বে না।
এছাড়াও, ধুঁধুলে আছে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফাইবার আমাদের পাকস্থলীতে জায়গা দখল করে, যার ফলে আমরা দ্রুত পেট ভরা অনুভব করি এবং খাওয়ার পরিমাণ কমে যায়। এটি ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং বারবার খাওয়ার প্রবণতা কমায়। একই সাথে, ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং নিয়মিত মলত্যাগের মাধ্যমে শরীরের বিপাক ক্রিয়া সচল রাখতে সাহায্য করে, যা স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।
ধুঁধুলের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এতে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে। এটি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে এবং শরীরের স্বাভাবিক বিপাক ও পরিশোধন প্রক্রিয়া সচল রাখে। এর ফলে শরীর থেকে দূষিত পদার্থগুলি নিষ্কাশিত হয়, শরীরে জমে থাকা বাড়তি জল বের হয়ে যায় এবং সামগ্রিকভাবে একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ধুঁধুলের অন্যান্য উপকারিতা
এছাড়াও, ধুঁধুলের ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ। রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল থাকলে হঠাৎ করে ক্ষুধা লাগা বা খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
তবে শুধু ওজন কমানোই নয়, ধুঁধুলের উপকারিতা আরও অনেক। হজম শক্তি উন্নত করা, ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো সহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে ধুঁধুল কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
আয়ুর্বেদশাস্ত্রে ধুঁধুল
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও ধুঁধুলের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতীয় উপমহাদেশের এই প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে ধুঁধুল গাছের বিভিন্ন অংশ নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। আয়ুর্বেদ মতে, ধুঁধুল শরীরের তিনটি দোষ (ভাত, পিত্ত এবং কফ) এর ভারসাম্য রক্ষা করে। এটি শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে, যা বিশেষত পিত্তের ভারসাম্যহীনতার কারণে সৃষ্ট প্রদাহ ও জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ধুঁধুলকে একটি প্রাকৃতিক শোধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি লিভার ও রক্তকে বিশুদ্ধ করে, দূষিত পদার্থ দূর করে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
এছাড়াও ধুঁধুল আমাদের হজম শক্তি বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এটি পিত্তকে উত্তেজিত না করেই হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং পেট ফাঁপা, বদহজমের মতো সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে, ধুঁধুল জন্ডিস এবং লিভারের অন্যান্য সমস্যা উপশমেও সাহায্য করে। ধুঁধুল ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্যও খুবই উপকারী। এর ঠান্ডা এবং বিশুদ্ধকারী গুণাবলী ত্বকের ব্রণ, ফুসকুড়ি এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত সমস্যা উপশমে সাহায্য করে।
উপাদান | প্রতি ১০০ গ্রাম ধুঁধুলে পরিমাণ | স্বাস্থ্য উপকারিতা |
---|---|---|
ভিটামিন এ | ৮৫ মাইক্রোগ্রাম | চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা, ইমিউন সিস্টেম বুস্ট করা |
ভিটামিন সি | ২৬ মিলিগ্রাম | ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করা, ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করা |
ভিটামিন ই | ০.২ মিলিগ্রাম | ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সাপোর্ট |
ডায়েটারি ফাইবার | ১.২ গ্রাম | হজমে সহায়তা, কনস্টিপেশন প্রতিরোধ, ওজন নিয়ন্ত্রণ |
পটাসিয়াম | ১৩৯ মিলিগ্রাম | রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষা |
ম্যাগনেসিয়াম | ১০ মিলিগ্রাম | পেশী ও নার্ভ ফাংশন বজায় রাখা, রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ |
ক্যালসিয়াম | ২০ মিলিগ্রাম | হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা, পেশী কার্যক্রম সহায়তা |
ফসফরাস | ৩৫ মিলিগ্রাম | হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য, শক্তি উৎপাদন |
আয়রন | ০.৪ মিলিগ্রাম | রক্তের হিমোগ্লোবিন উৎপাদন, ক্লান্তি কমানো |
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস | – | ফ্রি র্যাডিকেল ক্ষতি প্রতিরোধ, ক্রনিক ডিজিজের ঝুঁকি হ্রাস |
প্রোটিন | ০.৬ গ্রাম | কোষ মেরামত ও বৃদ্ধি, পেশী গঠন |
কার্বোহাইড্রেট | ৪.৩ গ্রাম | শক্তি উৎপাদন, দেহের মেটাবলিজম রক্ষণাবেক্ষণ |
ফ্যাট | ০.২ গ্রাম | শরীরের এনার্জি, ভিটামিন শোষণ |
তাই, ধুঁধুলকে শুধুমাত্র একটি সবজি হিসেবে না দেখে এর স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। নিয়মিত খাদ্যতালিকায় ধুঁধুল অন্তর্ভুক্ত করে আপনি এর স্বাস্থ্য উপকারিতা উপভোগ করতে পারেন। তবে যে কোনো নতুন খাবার বা চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া সবসময়ই উচিত।