প্রাচীন মিশরে, প্রায় চার হাজার বছর আগে, চিকিৎসা বিজ্ঞান আজকের মতো এত উন্নত না হলেও নিতান্তই অনুন্নত ছিল না। খননকার্যে প্রাপ্ত হাড়গোড় এবং প্রাচীন নথিপত্র থেকে জানা যায় যে তৎকালীন মিশরীয়রা নকল হাত-পা বানাতে পারতো এবং দাঁতের ফোকরও ভরাট করতে পারতো! আরো চমকপ্রদ তথ্য হলো- গবেষকরা বলছেন যে, মিশরীয়রা এমনকি মস্তিষ্কের ক্যান্সারের চিকিৎসাও করার চেষ্টা করেছিল, যদিও তাদের আজকের মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি বা জ্ঞান ছিল না।
‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন মেডিসিন’ নামক একটি গবেষণা পত্রিকায় গত ২৯ মে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে যেখানে একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী জানিয়েছেন যে, প্রায় ৪,০০০ বছর আগেকার দুটো মানুষের খুলির ওপর অস্ত্রোপচারের চেষ্টার চিহ্ন পাওয়া গেছে। জার্মানির টিউবিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক এবং এই গবেষণা পত্রের সহ-লেখক তাতিয়ানা টন্ডিনি বলেন, “প্রাচীন মিশরীয়রা জটিল মাথার খুলির ফাটল ঠিক করতে পারলেও ক্যান্সারের চিকিৎসা তখনও তাদের কাছে ছিল এক অজানা জগৎ। আমরা সেই সময়কার মানুষের ক্যান্সারের প্রকোপ কেমন ছিল আর এই রোগের সাথে তৎকালীন সমাজ কিভাবে মোকাবিলা করত সেটা জানতে চেয়েছিলাম।”
এই গবেষণায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকওয়ার্থ সংগ্রহশালার দুটো খুলি নিয়ে কাজ করা হয়েছে। ২৩৬ নম্বর খুলিটি খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮৭ থেকে ২৩৪৫ সালের মধ্যকার এবং ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী কোন পুরুষের। আর ‘E270’ নম্বর খুলিটি খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৩ থেকে ৩৪৩ সালের মধ্যকার এবং ৫০ বছরের বেশি বয়সী কোন নারীর।
২৩৬ নম্বর খুলিটিতে টিউমারের লক্ষণ পাওয়া গেছে, যা শরীরের কোন অংশের অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে হয়। তাছাড়া, এই খুলি জুড়ে প্রায় ৩০টি ছোট ছোট গোলাকার ক্ষত ছিল, যা ক্যান্সারের বিস্তারের ইঙ্গিত দেয়। খুলির এই ক্ষতগুলোর চারপাশে ধারালো কোন বস্তু, সম্ভবত ধাতব কোন যন্ত্র দিয়ে কাটার চিহ্ন পাওয়া গেছে। স্পেনের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল স্যাগ্র্যাট কোরের সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট এবং এই গবেষণা পত্রের আরেক সহ-লেখক অ্যালবার্ট ইসিড্রো বলেন, “প্রাচীন মিশরীয়রা ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি সম্পর্কিত কোনো ধরনের অস্ত্রোপচারের চেষ্টা করেছিল, যা প্রমাণ করে যে প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসাবিদ্যাও ক্যান্সারের ব্যাপারে পরীক্ষামূলক চিকিৎসা বা অনুসন্ধান চালাচ্ছিল।”
অন্যদিকে ‘E270’ খুলিটিতেও ক্যান্সারের বড় টিউমারের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মানে হলো প্রাচীনকালে ক্যান্সার একেবারে বিরল ছিল না। তাছাড়া এই খুলিটিতে আঘাতের দুটি ক্ষতও দেখা গেছে যেগুলো পরে সেরে গিয়েছিল। এর মধ্যে একটি ক্ষত সম্ভবত ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাছ থেকে আঘাত করার কারণে হয়েছিল। এই ক্ষত সেরে যাওয়ার মানে হলো যে ব্যক্তি সম্ভবত চিকিৎসা পেয়েছিলেন এবং বেঁচে ছিলেন।
নারীদের খুলিতে এ ধরনের ক্ষত পাওয়াটা অস্বাভাবিক, কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে সহিংসতা-জনিত আঘাতের চিহ্ন বেশিরভাগ পুরুষদের কঙ্কালেই পাওয়া যায়। তাই তাতিয়ানা টন্ডিনি ভাবছেন, “সেই নারী কি কোন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? যদি তাই হয়, তাহলে প্রাচীনকালে নারীদের ভূমিকা এবং তাদের সংঘাতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়ে আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে হবে।”
প্রাচীনকালের কঙ্কাল নিয়ে গবেষণা করা বেশ কঠিন, কারণ প্রায়ই পুরো কঙ্কাল পাওয়া যায় না এবং সেই সময়কার মানুষের চিকিৎসার কোন লিখিত নথিও থাকে না। তবে, অন্যান্য নমুনা নিয়ে আরো গবেষণা করলে প্রাচীন সমাজ ক্যান্সারের মতো রোগের সাথে কিভাবে মোকাবিলা করতো সে সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া যেতে পারে। স্পেনের সান্তিয়াগো দে কম্পোস্টেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্যালিওপ্যাথলজিস্ট এবং গবেষণা পত্রের সহ-লেখক এডগার্ড ক্যামারোস বলেন, “প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসাবিদ্যায় ৪,০০০ বছরেরও বেশি আগে ক্যান্সারের চিকিৎসা বা অনুসন্ধানের চেষ্টার এই প্রমাণ অনন্য। চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ায় এটি এক অসাধারণ নতুন দিক ।”
অতীতের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, তাদের লড়াই – এই সবকিছু জানার আগ্রহ সবসময়ই মানুষের মনে কৌতূহল জাগিয়ে রেখেছে। প্রাচীন মিশরীয়দের এই চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কার আমাদের অতীত সম্পর্কে জানার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। সেইসাথে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসকেও অন্য আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।