আমরা বাঙালি, মাছ ছাড়া আমাদের যেন চলেই না। বাঙালির রক্তের সাথে যেন মাছের এক অদ্ভুত সম্পর্ক! গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় নদী তো আছেই, তার সাথে গ্রামবাংলার অজস্র খাল, বিল, পুকুর – জলের কোনও অভাব নেই। আর সেই জল থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম উঠে এসেছে ইলিশ, রুই, কাতলা, তোপসে , পাবদা, ভেটকি , চিংড়ি, পাঙাশ… নাম করতে গেলে শেষ হবে না। দুপুরের পাতে কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখানো শিং মাছের ঝোল হোক, কিংবা সর্ষের তেলে ভাজা ইলিশ – মাছ তো থাকতেই হবে। মাছ শুধু আমাদের খাদ্য তালিকায় নেই, আমাদের সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু এই যে মাছের উপর এত ভালোবাসা, সেই মাছেই যদি লুকিয়ে থাকে ভয়ংকর বিষ?
মাছের চাহিদা এত বেড়ে গেছে যে চাহিদা পুরণ করাতে বড় বড় ভেড়ি জলাশয়ে কৃত্রিম ভাবে চাষ করা হচ্ছে বহু বছর ধরেই আজকাল তো আবার সিমেন্টের ট্যাংকেও ঠাসাঠাসি করে চাষ করা হচ্ছে এর পোশাকি নাম বায়োফ্লক ।
ব্যবসার জন্য দ্রুত মাছ বড় করার প্রয়োজন । আর মাছকে দ্রুত বড় করতে গিয়ে তাদের খাওয়ানো হচ্ছে এমন সব খাবার যা কেবল মাছকেই নয় যারা খাচ্ছে তাদের পাশাপাশি মাছ চাষীদেরও হচ্ছে মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি ।
মাছকে দ্রুত বড় করে তোলার জন্য তাদের খাবারের সাথে ফ্লোরাইড, আর্সেনিক, লেড – এর মত বিষাক্ত রাসায়নিক গুলির পাশাপাশি মাছকে রোগমুক্ত রাখতে ব্যবহার করা হয় বিপুল পরিমানে এন্টিবায়োটিক । মাছের খামারে এই এলোপাথাড়ি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের এক মারাত্মক দিক হলো এতে ব্যাকটেরিয়া মাছের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে নেয়। এরপর আমরা যখন সেই মাছ খাই তখন এইসব রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া খাওয়ার মাধ্যমে আমাদের শরীরে চলে আসে ফলে ভবিষ্যতে কোনো অসুখে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক কাজ নাও করতে পারে এমন সম্ভাবনা তৈরি হয় ।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ইতিমধ্যেই জানিয়েছে আমাদের রাজ্যে একটা বিরাট অঙ্কের রোগী পাওয়া যাচ্ছে যাদের শরীরে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে । এটি মারাত্মক , কারণ এর পর সামান্য জ্বর পেট ব্যথাতেই মানুষ মারা যেতে পারে যদি এন্টিবায়োটিক কাজ না করে ।
আর ফ্লোরাইড, আর্সেনিক, লেড – এর মত বিষাক্ত রাসায়নিক গুলি কী করতে পারে ?
ফ্লোরাইডঃ সামান্য পরিমাণ ফ্লোরাইড দাঁতের জন্য ভালো হলেও, অতিরিক্ত পরিমাণে মাছের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে নষ্ট হতে পারে দাঁত এবং হাড়। একে বলে ফ্লুরোসিস। মারাত্মক হলে মেরুদন্ডেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আর্সেনিকেরঃ আর্সেনিক এক ভয়ঙ্কর কার্সিনোজেন, অর্থাৎ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। দীর্ঘদিন ধরে এই বিষ শরীরে গেলে ত্বকের সমস্যা দেখা দেবেই, সাথে ফুসফুস, ত্বক ও মূত্রাশয় – এইসব অঙ্গের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
লেডঃ সীসা বা লেড যে স্নায়ুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকারক তা আমরা সবাই জানি, বিশেষত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। সীসার বিষক্রিয়ায় বাচ্চাদের বুদ্ধির বিকাশ ব্যাহত হয়, পড়াশোনায় সমস্যা হয়, আইকিউ কমে যায়। বড়দের উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনির রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
এই সব রাসায়নিকের দৌরাত্ম্যে শুধু যে মাছের ক্ষতি হয় তা নয়, গোটা এলাকার জলের পিএইচ লেভেল বা ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । এই পরিবেশে বেড়ে ওঠা মাছও তাই স্বাভাবিক ভাবেই শরীরে বেশি টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ জমা করে!
রুই, কাতলা, ইলিশ – বাঙালির গর্বের এই মাছগুলো তাই যেন বিষের জালে আটকে গেছে। যেই উপায়ে এদের দ্রুত বড় করা হচ্ছে, সেটাই এই মাছগুলোকে বিপজ্জনক করে তুলছে।
অনেক চাষী এখন অরগানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করছেন। পুকুরের পরিবেশ ঠিক রাখা, প্রাকৃতিক খাবার দেওয়া – এই পদ্ধতিতে ফলন হয়তো কম, কিন্তু যে মাছ খাব সেটা অন্তত বিষমুক্ত হবে।
বাঙালি ও বাঙালির প্রিয় মাছের ভবিষ্যৎ এখন বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। দ্রুত লাভের জন্য এই বিষাক্ত চাষ যতদিন চালিয়ে যাব ,ততদিন স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়বেই। মৎস্য দফতর ও স্বাস্থ্য দফতর যৌথ ভাবে এগিয়ে না এলে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয় ।