ঘরের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত জলে আয়রন থাকাটা এখন একটা নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা। জলের মধ্যে আয়রনের উপস্থিতি কিন্তু নানা রকমের সমস্যা তৈরি করে, যেমন – নল-বেসিনে দাগ পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে জলের স্বাদ পর্যন্ত খারাপ করে দেওয়া। তাই সমস্যাটা সম্পর্কে পরিষ্কার বোঝাপড়া থাকা এবং কার্যকরী সমাধানগুলো জানাটা খুব জরুরি।
জলের আয়রন
জলে পাওয়া যায় যেসব আয়রন
মূলত দুই রকমের আয়রন জলে পাওয়া যায়: ফেরাস আয়রন যেটা জলে গুলে থাকে , দেখা যায় না । আর ফেরিক আয়রন যেটা ক্ষুদ্র কণা হিসেবে ভাসতে থাকার কারণে জল কে লালচে রঙের করে দেয়। কোন ধরণের আয়রন সমস্যা তা বুঝতে পারলে সঠিকভাবে দূর করার উপায় বেছে নিতে সুবিধে হয়।
আয়রন সমৃদ্ধ জলের লক্ষণ
বাসনের নল বা সিঙ্কে বাদামী দাগ, কাপড় ধোয়ার পর কাপড়ে লালচে দাগ হয়ে যাওয়া, জলে ধাতব গন্ধ- এগুলো সবই আয়রন যুক্ত জলের লক্ষণ। এসব যত তাড়াতাড়ি দেখা যাবে, তত তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান করে বড় ঝামেলা এড়ানো যাবে।
কেন জল থেকে আয়রন দূর করা এত জরুরি?
স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
আয়রন খুবই দরকারি পুষ্টি উপাদান ঠিকই, কিন্তু জলে আয়রনের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে যেসব মানুষের হেমোক্রোমাটোসিস রোগ আছে (যে রোগে শরীর অতিরিক্ত আয়রন জমা করে রাখে), তাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা মারাত্মক হতে পারে।
পাইপলাইন আর যন্ত্রপাতির ক্ষতি
আয়রন পাইপের ভেতরে বা ওয়াটার হিটারের মধ্যে জমতে জমতে কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই ক্ষয়ক্ষতি ধীরেধীরে মেরামত খরচ বাড়িয়ে তোলেই।পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে নানাবিধ সমস্যা তৈরি করে ।
ঘরের জল থেকে আয়রন দূর করার উপায়
ফিল্টার ব্যবহার
সেডিমেন্ট ফিল্টার:
বড়সড় ফেরিক আয়রনের কণা আটকাতে এগুলো বেশ ভালো কাজ করে।
কার্বন ফিল্টার:
ছোট কণা দূর করে, জলের গন্ধ এবং স্বাদ ভালো করে।
কেমিকেল ফিড পাম্প
এসব সিস্টেম ক্লোরিনের মতো কেমিকেল জলে মেশায়, যাতে ফেরাস আয়রন অক্সিডাইজ হয়ে ফেরিক আয়রনে পরিণত হয় এবং ফিল্টার দিয়ে ছেঁকে ফেলা যায়।
ওয়াটার সফটনার
জলের খরতা কমিয়ে সফটনার কিছুটা আয়রনও দূর করতে পারে, বিশেষ করে যদি আয়রন আর খরতা দুটোই বেশি থাকে।
ঘরোয়া উপায়ে আয়রন দূর করার কৌশল
বালি–কয়লার ফিল্টার
সাধারণ বালি বা কাঠকয়লা দিয়ে সহজ ফিল্টার বানিয়ে ফেলা যায়, তবে এগুলো খুব বেশি কাজের না।
নিয়মিত প্লাম্বিং দেখভাল
নিয়মিতভাবে পাইপলাইন ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলে আয়রন একেবারে জমে যেতে পারে না।সেক্ষেত্রে আয়রণের সমস্যা কিছুটা কমলেও এটা স্থায়ী কোনো সমাধান নয় ।
দুটি আলাদা জলের ট্যাঙ্ক ব্যবহার
দুটি পৃথক জলের ট্যাঙ্ক ব্যবহার করুন । প্রথমটি ১০০০ হাজার লিটার এবং দ্বিতীয়টি ৫০০ লিটারের । প্রথম ট্যাঙ্কটির অবস্থান হবে দ্বিতীয় ট্যাংকটির উপরে । প্রথম ট্যাংকটিতে ঘরোয়া পদ্ধতিতে ফিল্টার লাগান । এই ফিলটারটি হবে পাঁচটি স্তরের সবার
- নিচেতে দিন স্পঞ্জ তার উপরে দিন ভাঙ্গা ইটের টুকরা প্লাস্টিকের নেটের মধ্যে প্যাক করে।
- তার উপরে দিন চারকোল সেটিও প্লাস্টিকের নেটের মধ্যে প্যাক করে ।
- তার উপরে দিন মোটা বালি সেটিও প্লাস্টিকের নেটে প্যাক করে ।
- এর উপরেই দিন বাজার থেকে কিনে আনা কুচি কুচি চুম্বকের গুড়া । এটিও প্লাস্টিকের নেটে ভরে দেবেন
- শেষে সবার উপরে আবার দিন ভাঙ্গা ইটের টুকরা ।
জল এসে পড়বে এই ভাঙ্গা ইটের টুকরার উপরে তারপর ফিলটার হয়ে শেষ স্তর অর্থাৎ স্পঞ্জে পৌছাবে । স্পঞ্জ থেকে জল আবার ফিল্টার হয়ে দ্বিতীয় ট্যাংকে এই পদ্ধতিটি তুলনামূলক স্থায়ী । তবে রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন ।
আরও বিস্তারিত জানতে ভিডিওটি দেখুন
পেশাদারী সহায়তা
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
কোন ধরণের আয়রন, কত পরিমাণ আয়রন – এসব ভালোভাবে পরীক্ষা করিয়ে যেকোনো ওয়াটার ট্রিটমেন্ট বিশেষজ্ঞ আপনার জন্য কাস্টমাইজড সমাধান বাতলে দিতে পারবেন।
আপনার জন্য সঠিক সিস্টেম
জল কতজন ব্যবহার করবে, আয়রনের পরিমাণ কেমন, বাজেট কত – এসব বিবেচনা করে তবেই পরিপূর্ণ জল বিশুদ্ধকরণ সিস্টেম কেনা উচিত।
আয়রন দূরীকরণ পদ্ধতির রক্ষণাবেক্ষণ
নিয়মিত চেকআপ
যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা নিশ্চিত করতে নিয়মিত চেক করা উচিত।
কখন ফিল্টার বদলাতে হয় ?
ফিল্টার কখন বদলাতে হবে, ব্যবহারের উপর তা নির্ভর করে। তবে সাধারণভাবে ৩-৬ মাস পর পর ফিল্টার বদলে দেওয়া ভালো।
আয়রন দূর করার নতুন নতুন প্রযুক্তি
জল বিশুদ্ধকরণে উন্নতি
রিসার্চের মাধ্যমে আয়রনের মতো ক্ষতিকর উপাদান আরও কার্যকরীভাবে এবং কম ঝামেলা করে দূর করার পদ্ধতি বের হয়ে আসছে। কিন্তু সেগুলি এখনো যথেষ্ট ব্যয়বহুল হওয়ায় জনসাধারনের নাগালে আসেনি ।
স্থায়ী সমাধান
পরিবেশ বান্ধব,কম খরচে আয়রন দূর করা যায় এমন প্রযুক্তি নিয়ে জোরদার গবেষণা চলছে ,আশা করা যায় দ্রুত ফলপ্রসূ হবে ।
এই বিষয়ে বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
ঘরোয়া ব্যবহারের জন্য কোনটা সবচেয়ে ভালো আয়রন দূর করার সিস্টেম?
এটা অনেক কিছুর উপরে নির্ভর করে – কেমন আয়রন, কতটা আয়রন, আপনার বাজেট ইত্যাদি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফটনার আর সেডিমেন্ট ফিল্টার একসাথে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
বাড়িতে বসেই কি জলে আয়রনের মাত্রা পরীক্ষা করা যায়?
হ্যাঁ, আয়রন পরীক্ষার জন্য বেশ কিছু কিট পাওয়া যায়। সেগুলি ব্যবহার করলে দ্রুত নির্ণয় করা সম্ভব জলে কতটা আয়রন আছে ।
আয়রন রিমুভাল সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা বুঝবো কীভাবে?
জলে কোনো অস্বস্তিকর গন্ধ না পেলেই বুঝবেন আয়রণ রিমুভাল সিস্টেম কাজ করছে
আয়রন রিমুভাল সিস্টেম কত ঘনঘন মেইনটেন করা দরকার?
আপনার সিস্টেম এবং জলে আয়রনের মাত্রার উপর নির্ভর করে। তবে সাধারণত, ৩-৬ মাস অন্তর ফিল্টার চেক করে বদলে দেওয়া ভালো আইডিয়া।
আয়রন সমৃদ্ধ জল কি পান করার জন্য নিরাপদ?
খুব কম পরিমাণ আয়রন থাকলে জলে তেমন সমস্যা নেই। তবে আয়রন বেশি থাকে সেই জল দীর্ঘদিন পান করা ক্ষতিকারক, তাই পরিশোধন করে নেওয়া জরুরি।
ওয়াটার সফটনার কি আয়রন দূর করতে পারে?
হ্যাঁ, ওয়াটার সফটনার আয়নের বিনিময় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফেরাস আয়রন দূর করতে পারে। তবে জলে যদি ফেরিক আয়রন বেশি থাকে, তাহলে অতিরিক্ত ফিল্টারেরও প্রয়োজন হতে পারে।
ঘরের জলের আয়রন দূরীকরণ পদ্ধতি বোঝা এবং সমস্যা সমাধান করা সুস্থতার জন্য খুবই জরুরি। এই পদ্ধতি আপনার জল কে নিরাপদ করবে, গৃহস্থালির যন্ত্রপাতিগুলো ভালো রাখবে। উপযুক্ত জ্ঞান এবং সরঞ্জামগুলো নিয়ে আপনি আপনার ঘরের জল থেকে কার্যকরভাবে আয়রন দূর করতে পারবেন, এবং নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারবেন। এতে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, আর অযথা যন্ত্রপাতি মেরামতের খরচটাও কমবে।