অতি সম্প্রতি মোদী সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA)-এর বিস্তারিত নিয়মাবলী প্রকাশ করেছে। বিতর্কিত ইলেক্টোরাল বন্ড বিতর্ক থেকে আলোচনা সরানোর যে রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, CAA দিয়ে তা পুরোপুরি ধামাচাপা দিতে পারেনি। CAA নিয়ে আলোচনা প্রায় থেমে গিয়েছিল, হঠাৎ দুটি ঘটনা একে আবার খবরে নিয়ে আসে।
প্রথমে, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল আইনটিকে সমালোচনা করলেন। তিনি বললেন এটা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ নতুন করে ভারতে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি করবে । এই মন্তব্যের জেরে দিল্লিতে শরণার্থী হিসেবে বসবাসকারী শত শত পাকিস্তানি হিন্দুরা কেজরিওয়ালের বাড়ির বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
আরও বড় ভূমিকা নেয় আমেরিকা। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন তারা এই আইনে উদ্বিগ্ন। সব ধর্মের প্রতি সাম্যের পক্ষে আমেরিকার অবস্থান জানিয়ে তিনি বলেন, আইনটি আমেরিকা আন্তরিকতার সাথে পর্যালোচনা করছে।
তবে আসুন সত্যি CAA আইনটি খতিয়ে দেখি – এটা ভালো, খারাপ, দুইয়ের মিশেল, নাকি এর কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবই নেই? চলুন সম্ভাব্য সুবিধাভোগী, ক্ষতিগ্রস্ত এবং যুক্তিবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝার চেষ্টা করি।
- সবচেয়ে বেশি যাদের লাভ হওয়ার কথা: পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়। এদের সঠিক সংখ্যা জানা কঠিন। ধরে নিই দুই কোটির মতো, যাদের ৯৫% হিন্দু। তারা কি ভারতে আসতে আগ্রহী? দুর্ভাগ্যবশত, উত্তর হল ‘না’। কারণ, আইনের সুবিধা পেতে ২০১৪-এর আগেই ভারতে আসতে হবে।
- তাহলে যারা আগে এসেছে, তারা লাভবান হবে? হ্যাঁ, তবে তারাও প্রশ্ন তুলতে পারে যে ভারতে তাদের দুর্দশা নিয়ে মোদী সরকার এতো উদ্বিগ্ন হলে, গত দশ বছরে নাগরিকত্ব কেন দেওয়া হলো না? ভারত কাউকে নাগরিকত্ব দিতে আলাদা আইনের দরকার নেই। কিংবদন্তি গায়ক আদনান সামিকে নাগরিকত্ব দেওয়া তো টিভিতে ধুমধাম করে দেখানো হয়েছিল! পাকিস্তান-বাংলাদেশের দরিদ্র হিন্দুদের দশ বছর অমানবিক অবস্থায় কেন রাখা হলো? রাজনৈতিক লাভের জন্য কি তাদের অপেক্ষার সময় বাড়ানো হয়েছে?
- যারা ভয় পাচ্ছিল? তারা কেন এখন শাহীনবাগের মতো আন্দোলন করছে না? কারণ, ২০১৯ সালের বিক্ষোভের মূল উদ্বেগ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC)। NRC-কে CAA অনুসরণ করবে বলে সরকারপক্ষ থেকেই বলা হয়েছিল। কিন্তু NRC নিয়ে এতো হইচইয়ের পর, ২০১৯-এর ডিসেম্বরে রামলীলা ময়দানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদী NRC প্রসঙ্গকে অস্বীকার করেন। স্পষ্টতই বোঝা যায় সরকার নিজেদের ভুল বুঝে পিছিয়ে এসেছে। আরব দেশগুলি থেকে সম্মাননা, পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে ঘিরে ফেলা – এই সুবিধাগুলি মোদী হাতছাড়া করতে চান না। তারপর থেকে NRC নিয়ে আর কোনও বিজেপি নেতাই কথা বলেননি। NRC না থাকলে ভারতীয় মুসলিমদের আর ভয়ের কিছু নেই।
- CAA-এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব কোথায়? আসামে। আসামের বাঙালি-বিরোধী আন্দোলনের প্রভাবের কারণেই আসামের জন্য নাগরিকত্ব আইনে আলাদা নিয়ম আছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসামীয়রা বিশ্বাস করে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ অবৈধ অভিবাসী আসামের জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। হিন্দু-মুসলিম আলাদা করে দেখার রাজনীতি চালিয়ে সেখানে RSS বেশ খানিকটা সফল হলেও, অসামীয় অসন্তোষ পুরোপুরি দূর হয়নি।
NRC প্রক্রিয়া আসামে হয়ে গেছে এবং সেখানে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিপুল সংখ্যক হিন্দুকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এখন বলছেন CAA-তে লাভবান হতে যাওয়া বাঙালি হিন্দুদের সংখ্যা খুবই সামান্য। হলেও মাত্র ৫০-৮০ হাজার। এত কম লোকের জন্য এতো বিতর্কিত আইন আদৌ দরকার ছিল কি?
এটা বলাই যায় যে বিজেপির জন্য এটা রাজনৈতিক চাল ছিল, কিন্তু তা পুরোপুরি কাজে আসেনি। যাদের নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব, পুরনো আইনেই তাদের দেওয়া যেত। আর নতুন যারা আসতে চাইবে, তারা তো বাদ পড়েই যাবে। সমগ্র দেশে বিভাজন আর আন্দোলনের আশাও প্রধানমন্ত্রী নিজেই ভেস্তে দিয়েছেন NRC প্রত্যাহার করে।
মুসলিম সম্প্রদায়ও বুদ্ধিমানের মতো বড় প্রতিক্রিয়া থেকে সরে এসেছে। মূলত সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে আইনটি সাংবিধানিক কিনা, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া যায় কিনা সেই নিয়ে। রায় যাই আসুক, আসল পরিস্থিতিতে তেমন কোনো বদল হবে না।
CAA নিয়ে আবার হইচই শুরু হতে পারে, শুধু যদি আবার NRC-র হুমকি ওঠে, অথবা ২০১৪-এর কাট-অফ ডেট বদলানো হয়। ২০২৯-এর নির্বাচনের আগে এসব নিয়ে আবার নাড়াচাড়া হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।