ডায়াবেটিস হল একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা, যা তখন ঘটে যখন দেহের রক্তে শর্করার মাত্রা বা গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থাটির প্রধান কারণ হল ইনসুলিন নামক হরমোনের কার্যকারিতা বা উৎপাদনে সমস্যা। ইনসুলিন হল একটি হরমোন যা প্যানক্রিয়াস থেকে নিঃসৃত হয় এবং এটি রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ডায়াবেটিসের প্রধানত দু’টি প্রকারভেদ রয়েছে: টাইপ ১ এবং টাইপ ২। টাইপ ১ ডায়াবেটিস হল একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে দেহের ইমিউন সিস্টেম প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদক কোষগুলিকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। এটি সাধারণত বাচ্চা ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে দেখা যায়। অন্যদিকে, টাইপ ২ ডায়াবেটিস হল একটি মেটাবলিক ডিসঅর্ডার, যেখানে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয় বা তৈরি হওয়া ইনসুলিন সক্রিয়ভাবে কাজ করে না। এটি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
ডায়াবেটিসের কারণগুলি বিভিন্ন হতে পারে। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণগুলি মূলত দায়ী। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে জেনেটিক প্রভাবের পাশাপাশি জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসের ভূমিকা রয়েছে। অতিরিক্ত ওজন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চার অভাব এবং উচ্চ রক্তচাপ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।
ডায়াবেটিসের প্রভাব সারা শরীরে দেখা যায়। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রিত না থাকলে, এটি হার্ট, কিডনি, চোখ এবং স্নায়ুতন্ত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়াও, ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রুটিন
🔎︎ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রোজকার রুটিনের গুরুত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত রুটিন মেনে চলা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে, কারণ এটি রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত রুটিনের মধ্যে সঠিক সময়ে খাবার খাওয়া, ব্যায়াম করা, পর্যাপ্ত ঘুম ও ওষুধ গ্রহণ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
সঠিক রুটিন মেনে চলার ফলে ডায়াবেটিস রোগীরা তাদের শরীরের শর্করার ওঠা-নামা পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেলে শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
রুটিন গঠন করার সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। প্রথমত, খাবার খাওয়ার সময় নির্দিষ্ট করা উচিত এবং প্রতিদিন একই সময়ে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। দ্বিতীয়ত, সঠিক সময়ে ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। ব্যায়াম শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়ক।
তৃতীয়ত, পর্যাপ্ত ঘুমের গুরুত্বও কম নয়। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করা প্রয়োজন, কারণ পর্যাপ্ত ঘুম না হলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। চতুর্থত, ওষুধ গ্রহণের সময় সূচি ঠিকঠাক মেনে চলতে হবে। নিয়মিতভাবে ওষুধ গ্রহণ করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
এছাড়া, রুটিন মেনে চলার ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মানসিক চাপ কমানোর জন্য ধ্যান, যোগ এবং অন্যান্য চাপ মুক্তির কার্যক্রম যুক্ত করা যেতে পারে। এতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হয়ে ওঠে।
সুতরাং, সঠিক রুটিন মেনে চলার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নিয়মিত রুটিনের মাধ্যমেই ডায়াবেটিস রোগীরা একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন।
সঠিক সময়মতো খাবার গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঠিক সময়মতো খাবার গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খাবারের সময়সূচি মেনে চলা একটি কার্যকর উপায়, কারণ এটি রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে খাবার গ্রহণ করলে শরীরের ইনসুলিন উৎপাদন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কাজ করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বৃদ্ধি বা হ্রাস পায় না।
প্রথমত, সকালের নাস্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকাল বেলা পরিমাণমতো প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে দিনের শুরুতেই শরীর পর্যাপ্ত শক্তি পায় এবং মেটাবলিজম প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। সকালের নাস্তায় ওটমিল, দই, ফলমূল, অথবা হোল গ্রেইন ব্রেডের সাথে ডিম অথবা বাদাম যুক্ত করে নিতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, দুপুরের খাবারের সময়ে একটি পরিমিত খাবার গ্রহণ করা উচিত। দুপুরের খাবারে শাকসবজি, প্রোটিন, এবং কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার থাকা আবশ্যক। এখানে ব্রাউন রাইস, গ্রিলড চিকেন, এবং সবুজ শাকসবজি মিশ্রিত সালাদ ভাল অপশন হতে পারে। দুপুরের খাবার পরিমাণমতো হলে তা শরীরকে দীর্ঘ সময়ের জন্য শক্তি প্রদান করে এবং বিকেলের ক্ষুধা কমায়।
তৃতীয়ত, সন্ধ্যার খাবার গ্রহণ করার সময় সতর্ক থাকতে হবে। রাতের খাবার যতটা সম্ভব হালকা এবং সহজপাচ্য হওয়া উচিত। রাতের খাবারে স্যুপ, সবজি, এবং লো-ফ্যাট প্রোটিন যেমন মাছ বা মুরগি উপযুক্ত হতে পারে। রাতের খাবার খুব দেরি করে খাওয়া উচিত নয়, কারণ তা হজম প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খাবারের সময়সূচি মেনে চলা একটি অভ্যাসে পরিণত করা উচিত। এই অভ্যাসটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে এবং শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। নিয়মিত এবং সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা আরও সহজ হয়ে ওঠে।
স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকা
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক খাদ্যাভ্যাস রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। প্রথমত, আঁশযুক্ত খাবার যেমন শাকসবজি, ফলমূল এবং সম্পূর্ণ শস্য ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এগুলির মধ্যে থাকা আঁশ হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বেড়ে যাওয়া রোধ করে।
প্রোটিনের ভালো উৎস হিসেবে মুরগির মাংস, মাছ, ডাল এবং বাদাম খাওয়া যেতে পারে। মাংসের ক্ষেত্রে চর্বি মুক্ত অংশ বেছে নেওয়া উচিত। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ যেমন স্যামন, ম্যাকারেল রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
স্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন অ্যাভোকাডো, অলিভ অয়েল এবং বাদাম থেকেও শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া যায়। তবে এসব খাবার যেমন পুষ্টিকর, তেমনই উচ্চ ক্যালোরি সম্পন্ন, তাই পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি।
ডায়াবেটিস রোগীদের কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের ক্ষেত্রে সচেতন থাকা উচিত। পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট যেমন সাদা রুটি, পাস্তা এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা ভালো। পরিবর্তে সম্পূর্ণ শস্য যেমন ব্রাউন রাইস, ওটস এবং কোয়িনোয়া বেছে নেওয়া যেতে পারে যা শর্করার স্তর ধীরগতিতে বাড়ায়।
ফলমূলের ক্ষেত্রে, আপেল, বেরি এবং চেরির মতো ফল খাওয়া যেতে পারে যা গ্লাইসেমিক ইনডেক্সে নিম্ন। যেসব ফলের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স উচ্চ, যেমন কলা এবং আঙুর, তা পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।
এছাড়া, বেশ কিছু পানীয়ও এড়িয়ে চলা উচিত। চিনিযুক্ত পানীয়, অ্যালকোহল এবং উচ্চ ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে। পরিবর্তে, জল, গ্রীন টি এবং হালকা লেবু জল খাওয়া যেতে পারে যা শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটের সঠিক ভারসাম্য
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাদ্যতালিকার সঠিক ভারসাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটের সঠিক অনুপাত ডায়াবেটিস রোগীদের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।
প্রোটিন শরীরের কোষ গঠনে এবং মাংসপেশী মজবুত রাখতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য প্রোটিনের সঠিক পরিমাণ গ্রহণ করা জরুরি, কারণ এটি রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। মাছ, ডিম, মুরগির মাংস, বাদাম এবং দুগ্ধজাত পণ্য থেকে সহজেই প্রোটিন পাওয়া যায়।
কার্বোহাইড্রেট খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তবে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এর সঠিক পরিমাণ এবং ধরণ নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) যুক্ত কার্বোহাইড্রেট যেমন শস্য, সবজি এবং ফলমূল রক্তের শর্করা ধীরে ধীরে বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল রাখে। উচ্চ জিআই যুক্ত খাবার যেমন চিনি, মিষ্টান্ন এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এড়িয়ে চলা উত্তম।
ফ্যাটও শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়, তবে সঠিক ধরনের ফ্যাট বেছে নেওয়া উচিত। অসম্পৃক্ত ফ্যাট যেমন অলিভ ওয়েল, বাদাম এবং অ্যাভোকাডো ভালো ফ্যাট হিসেবে পরিচিত। এই ফ্যাট রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। সম্পৃক্ত ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এগুলি ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সুষম খাদ্য পরিকল্পনা করার সময় প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা আবশ্যক। একটি পুষ্টিকর এবং সুষম খাদ্য পরিকল্পনা খাদ্যাভ্যাসের নিয়মিততা নিশ্চিত করে, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
নিয়মিত শারীরিক ব্যায়ামের প্রভাব
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক ব্যায়াম রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। ব্যায়াম করার ফলে শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনকে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
দৈনিক অন্তত ৩০ মিনিট মাঝারি ধরনের ব্যায়াম যেমন হাঁটা, সাইকেল চালানো বা সাঁতার ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপযোগী। এছাড়াও, শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম যেমন ওজন তোলা বা রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিংও উপকারি হতে পারে। এই ধরনের ব্যায়াম পেশীর শক্তি বাড়ায় এবং শরীরের গ্লুকোজ ব্যবহারের ক্ষমতা উন্নত করে।
শারীরিক ব্যায়াম শুধুমাত্র রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণেই সাহায্য করে না, এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সহায়তা করে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকলে ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
ডায়াবেটিস রোগীদের ব্যায়াম করার আগে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক ব্যায়ামের ধরন এবং মাত্রা নির্ধারণ করতে সাহায্য করতে পারেন। ব্যায়াম শুরু করার আগে এবং পরে রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত যাতে ব্যায়ামের প্রভাব বোঝা যায় এবং প্রয়োজনে ডোজ সমন্বয় করা যায়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। এটি শুধু রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। সুতরাং, ডায়াবেটিস রোগীরা নিয়মিত ব্যায়ামকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হিসেবে গ্রহণ করলে তা তাদের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে।
জল এবং অন্যান্য পানীয়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য জল এবং অন্যান্য পানীয়র ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা শরীরের বিভিন্ন কার্যকারিতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। জল শরীরের কোষগুলোকে হাইড্রেটেড রাখে এবং রক্তে শর্করার স্তর নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য প্রতিদিন অন্তত ৮ গ্লাস জল পান করা অত্যাবশ্যক।
বিশুদ্ধ জল পান করা ছাড়াও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর পানীয় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রীন টি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। গ্রীন টি-তে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পলিফেনল থাকে যা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং রক্তে শর্করার স্তর কমাতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে, ফলের রস পান করার সময় সতর্কতা প্রয়োজন। যদিও ফলের রস কিছু পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে, তবে এতে প্রাকৃতিক শর্করার পরিমাণও বেশি থাকে যা রক্তে শর্করার স্তর দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই, সম্পূর্ণ ফল খাওয়াই ভালো।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আরেকটি ভালো বিকল্প হলো নিম্ন ক্যালোরির পানীয়। যেমন, লো-ফ্যাট বা স্কিম মিল্ক এবং আনসুইটেনড বাদাম দুধ। এই ধরনের পানীয়গুলি প্রোটিন এবং ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস হতে পারে যা রক্তে শর্করার স্তর নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
অ্যালকোহল সেবনের বেলায় ডায়াবেটিস রোগীদের সতর্ক থাকা উচিত। অ্যালকোহল রক্তে শর্করার স্তর হঠাৎ করে কমিয়ে দিতে পারে এবং হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই, অ্যালকোহল সেবন করলে তা সীমিত পরিমাণে এবং নিত্যনৈমিত্তিক খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত।
সার্বিকভাবে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে জল এবং স্বাস্থ্যকর পানীয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পানীয় নির্বাচন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অপরিহার্য।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ, যা নিয়মিত মনিটরিং এবং চিকিৎসা ছাড়া সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা যেমন রক্তের শর্করার মাত্রা পরীক্ষা, HbA1c পরীক্ষা, রক্তচাপ মাপা, এবং লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা অন্যতম। এই পরীক্ষাগুলি রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয় এবং চিকিৎসকের জন্য রোগীর চিকিৎসা পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে।
রক্তের শর্করার মাত্রা পরীক্ষা হলো ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS) এবং পোস্টপ্র্যান্ডিয়াল ব্লাড সুগার (PPBS) পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী জানতে পারেন তাদের রোজকার রক্তের শর্করার মাত্রা কতটা নিয়ন্ত্রণে আছে। HbA1c পরীক্ষা তিন মাসের গড় রক্তের শর্করার মাত্রা নির্ধারণ করে, যা দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডায়াবেটিসের কারণে রোগীদের রক্তচাপ এবং লিপিড প্রোফাইল নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন জটিলতা, যেমন হার্টের রোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই, এই পরীক্ষাগুলি নিয়মিতভাবে করানো উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অপরিহার্য। চিকিৎসক রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পরিকল্পনা নির্ধারণ করেন এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ, খাদ্য পরিকল্পনা এবং জীবনধারা পরিবর্তন করা উচিত। এছাড়া, চিকিৎসক রোগীদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করেন এবং প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন।