ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। এই ভাইরাসটি বংশগতভাবে ফ্ল্যাভিভাইরাস পরিবারের অন্তর্গত এবং এটি বিশ্বের উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলে বিশেষভাবে প্রচলিত। ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণত উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, এবং শারীরিক দুর্বলতা হিসেবে প্রকাশ পায়।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রধান স্ট্রেন রয়েছে: ডেঙ্গু ভাইরাস ১ (DENV-1), ডেঙ্গু ভাইরাস ২ (DENV-2), ডেঙ্গু ভাইরাস ৩ (DENV-3), এবং ডেঙ্গু ভাইরাস ৪ (DENV-4)। এই স্ট্রেনগুলো বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে এবং একই ব্যক্তির মধ্যে একাধিকবার ডেঙ্গু হতে পারে।
ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রধান বাহক এডিস মশা, বিশেষ করে এডিস এজিপ্টাই প্রজাতি, যা দিনের বেলায় এবং সাধারণত ভোর ও সন্ধ্যার সময় বেশি সক্রিয় থাকে। মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাসটি প্রথমে রক্তে প্রবেশ করে এবং পরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
ডেঙ্গুর লক্ষণগুলি সংক্রমণের ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করে। প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণত উচ্চ জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশী ও জয়েন্টের ব্যথা, বমি বমি ভাব, এবং লাল দানা দানা র্যাশ হিসেবে দেখা দেয়। এই লক্ষণগুলো সাধারণত ২ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হতে পারে।
ডেঙ্গুর তীব্রতা এবং উপসর্গের প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারে, যা রোগী ও ভাইরাসের স্ট্রেনের উপর নির্ভর করে। কিছু ক্ষেত্রে, ডেঙ্গু মারাত্মক রূপ নিতে পারে এবং ডেঙ্গু হেমোরাজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে পরিণত হতে পারে, যা দ্রুত চিকিৎসা না হলে প্রাণঘাতী হতে পারে।
ডেঙ্গুর ইতিহাস
ডেঙ্গুর ইতিহাস অত্যন্ত পুরনো এবং বহু শতাব্দী ধরে এটি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। প্রাচীনকালে ডেঙ্গু রোগটি বহুবার মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অনেক মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। যদিও ডেঙ্গুর প্রথম নির্ভুল বর্ণনা পাওয়া যায় ১৮শ শতাব্দীতে, তবে এর প্রাদুর্ভাব আরও প্রাচীনকাল থেকেই ছিল বলে ধারণা করা হয়।
১৭৭৯ এবং ১৭৮০ সালের মধ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, এবং উত্তর আমেরিকায় একযোগে ডেঙ্গু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ডেঙ্গু সংক্রমণের আরও নথিভুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯শ এবং ২০শ শতাব্দীতে বহু দেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যা অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়।
ডেঙ্গু মূলত গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপগ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। এসব অঞ্চলে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া এবং মশার বিস্তার ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণকে ত্বরান্বিত করে। ডেঙ্গু ভাইরাসটি এডিস মশার মাধ্যমে সংক্রমিত হয়, বিশেষ করে Aedes aegypti প্রজাতির মশা এই ভাইরাসের প্রধান বাহক।
ডেঙ্গু ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, প্রাথমিকভাবে এটি বন্যপ্রাণীদের মধ্যে প্রবাহিত হত এবং পরবর্তীতে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বনের কাছাকাছি বসবাসকারী জনগোষ্ঠী এবং পশুপাখির মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং মশার মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমান সময়েও ডেঙ্গু একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপগ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবং নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও, এর পুরোপুরি নির্মূল করা এখনো সম্ভব হয়নি।
ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রক্রিয়া
ডেঙ্গু ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে সংক্রমিত হয়, যা সাধারণত এডিস এজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিক্টাস প্রজাতির মশা। এই মশাগুলি বৃহত্তর অংশে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার বাসিন্দা, যেখানে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি। ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়।
প্রথমত, যখন একটি এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন ভাইরাসটি মশার দেহে প্রবেশ করে। মশার রক্ত গ্রহণের সময় ভাইরাসটি মশার অন্ত্রের কোষে প্রাথমিকভাবে আসে এবং সেখান থেকে মশার অন্যান্য দেহের অংশে ছড়িয়ে পড়ে। মশার দেহে ভাইরাসটি বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়, যা পরবর্তীতে মশার মুখের লালা গ্রন্থিতে পৌঁছায়।
পরবর্তী ধাপে, যখন এডিস মশা পুনরায় কোনো স্বাস্থ্যকর ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন মশার লালা গ্রন্থি থেকে ভাইরাসটি নতুন ব্যক্তির রক্তে প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়ায়, ভাইরাসটি ব্যক্তির শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং ডেঙ্গু সংক্রমণ সৃষ্টি করে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয় যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী ও জয়েন্টে ব্যথা এবং র্যাশ ইত্যাদি।
ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণরূপে মশার উপর নির্ভরশীল, এবং তাই মশার সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং তাদের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ যেমন জলাবদ্ধ স্থান পরিষ্কার রাখা, মশারি ব্যবহার এবং মশা নিরোধক স্প্রে ব্যবহার করা ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণ
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা সাধারণত এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের ৪-১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয় এবং এই লক্ষণগুলো অনেক সময় অন্যান্য রোগের সাথে মিশে যেতে পারে, তাই সঠিকভাবে চিহ্নিত করাটা জরুরি।
প্রথমত এবং প্রধানত, ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উচ্চ জ্বর। এই জ্বর সাধারণত হঠাৎ করে আসে এবং তাপমাত্রা অনেক সময় ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। উচ্চ জ্বরের সাথে সাথে তীব্র মাথাব্যথা ডেঙ্গুর আরেকটি সাধারণ লক্ষণ। এই মাথাব্যথা বিশেষত মাথার সামনের দিকে কেন্দ্রীভূত থাকে।
চোখের পেছনে ব্যথা বা চোখের চারপাশে অস্বস্তি ডেঙ্গুর আরেকটি সাধারণ লক্ষণ। এই ব্যথা সাধারণত চোখের গ্লোবের পেছনে অনুভূত হয় এবং চোখ ঘোরানোর সময় আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তাছাড়া, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পেশী ও গাঁটে ব্যথা খুবই সাধারণ। এই ব্যথাকে অনেক সময় “ব্রেকবোন ফিভার” বলা হয়, কারণ এটি অনেক সময় এতটাই তীব্র হয় যে মনে হয় হাড় ভেঙে যাচ্ছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় বমি বমি ভাব বা বমি অনুভব করতে পারেন। এই লক্ষণটি সাধারণত উচ্চ জ্বরের সাথে মিলে যায় এবং অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া, ডেঙ্গু আক্রান্তদের ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। এই র্যাশ সাধারণত লালচে এবং সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ডেঙ্গুর এই সাধারণ লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত, কারণ ডেঙ্গু তীব্র আকার ধারণ করতে পারে এবং সময়মতো চিকিৎসা না হলে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF)
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) হলো ডেঙ্গুর একটি গুরুতর ফর্ম যা সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর থেকে বেশ পার্থক্যপূর্ণ। DHF এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তীব্র রক্তক্ষরণের ঝুঁকি এবং প্লেটলেট সংখ্যা দ্রুত কমা। এটি মূলত ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট হয়, যা মশার মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা যায়, এবং এর লক্ষণগুলো আরও তীব্র ও সংকটাপন্ন। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ যেমন উচ্চ তাপমাত্রা, তীব্র মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, এবং শরীরের ব্যথা ছাড়াও DHF এ রক্তক্ষরণ, চামড়ায় র্যাশ এবং লিভারের সমস্যা দেখা দেয়। প্লেটলেট সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
DHF এর ক্ষেত্রে, রক্তক্ষরণের লক্ষণগুলো যেমন নাক দিয়ে রক্ত পড়া, মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া, এবং প্রস্রাব ও মল ত্যাগের সময় রক্ত দেখা দিতে পারে। এছাড়াও, রোগীর ত্বকের নিচে ছোট ছোট রক্তক্ষরণ দেখা যেতে পারে, যাকে পিটেকিয়া বলা হয়। এই রক্তক্ষরণগুলো প্রায়ই তীব্র আকার ধারণ করে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পেলে জীবনঘাতী হতে পারে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার এর চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা জরুরি। রোগীকে যথাযথ পর্যবেক্ষণে রাখা, শরীরে পর্যাপ্ত তরল সরবরাহ করা এবং প্লেটলেটের সংখ্যা নিয়মিত পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুতর ক্ষেত্রে, হাসপাতালে ভর্তি করে বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার একটি জটিল ও বিপদজনক রোগ, যা সময়মতো শনাক্ত ও চিকিৎসা করা না হলে জীবনহানির কারণ হতে পারে। তাই, ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম (DSS)
ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম (DSS) ডেঙ্গুর সবচেয়ে গুরুতর ফর্মের মধ্যে একটি, যা 🔎︎ রক্তচাপ কমে যাওয়ার কারণে শক অবস্থার সৃষ্টি করে। এই অবস্থাটি ডেঙ্গুর অন্যান্য ফর্মগুলির তুলনায় অনেক বেশি বিপজ্জনক এবং অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। DSS এর সময় রোগীর রক্তচাপ এতটাই কমে যায় যে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্তের প্রবাহ ঠিকমতো পৌঁছাতে পারে না, ফলে জীবন-হুমকির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
DSS এর প্রধান লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে তীব্র পেট ব্যথা, অবিরাম বমি, রক্তক্ষরণ, এবং ত্বকের নীচে রক্ত জমাট বাঁধা। রোগীর অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে পারে এবং শক অবস্থায় পৌঁছালে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমের চিকিৎসা সাধারণত হাসপাতালের আইসিইউতে করা হয়, যেখানে রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর নিবিড় নজর রাখা হয় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরবরাহ করা হয়। রোগীর শরীরে তরল সরবরাহ করা এবং রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখার জন্য বিশেষ চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
DSS এর ঝুঁকি কমানোর জন্য ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অপরিহার্য। ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমের ঝুঁকি এড়াতে মশার বিস্তার রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
এক নজরে প্রাথমিক, মাঝারি, এবং তীব্র ডেঙ্গুর লক্ষণ
পর্যায় | লক্ষণ |
---|---|
প্রাথমিক | – হঠাৎ উচ্চ জ্বর (১০৪°F বা ৪০°C এর বেশি) |
– তীব্র মাথাব্যথা | |
– চোখের পেছনে ব্যথা | |
– পেশী ও জয়েন্টে ব্যথা | |
– বমি বমি ভাব বা বমি | |
– ত্বকে র্যাশ (লালচে দাগ) | |
– হালকা রক্তক্ষরণ (নাক, মাড়ি, বা ত্বক থেকে) | |
মাঝারি | – পেট ব্যথা ও অস্বস্তি |
– ঘন ঘন বমি করা | |
– ক্লান্তি ও দুর্বলতা | |
– শ্বাসকষ্ট | |
– নাক বা মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ | |
– ত্বকে বড় লালচে দাগ বা র্যাশ | |
তীব্র (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম) | – প্লাটিলেট সংখ্যা হ্রাস |
– প্লাজমা লিক (রক্ত থেকে তরল বেরিয়ে আসা) | |
– তীব্র পেট ব্যথা | |
– নিয়মিত বমি করা | |
– গাঢ় রক্তযুক্ত বমি বা মল | |
– তীব্র শ্বাসকষ্ট | |
– চামড়া ঠান্ডা এবং স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ওঠা | |
– নিম্ন রক্তচাপ | |
– অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দুর্বলতা এবং শক (জীবন সংকটাপন্ন অবস্থা) |
ডেঙ্গুর নির্ণয় পদ্ধতি
ডেঙ্গু রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা রোগের সঠিক শনাক্তকরণ এবং উপযুক্ত চিকিৎসা প্রয়োগে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রধান নির্ণয় পদ্ধতিগুলির মধ্যে অন্যতম হলো রক্ত পরীক্ষা। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়।
রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি ডেঙ্গু এনএস১ এন্টিজেন টেস্টও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণয় পদ্ধতি। এই টেস্টের মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রাথমিক উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। এনএস১ এন্টিজেন সাধারণত সংক্রমণের প্রথম সপ্তাহে রক্তে উপস্থিত থাকে, যা দ্রুত শনাক্তকরণের জন্য সহায়ক।
ডেঙ্গু নির্ণয়ের আরও একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হলো ডেঙ্গু আইজিজি/আইজিএম এন্টিবডি টেস্ট। এই টেস্টের মাধ্যমে শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে উৎপন্ন এন্টিবডির উপস্থিতি নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত, সংক্রমণের পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে আইজিএম এন্টিবডি শনাক্ত করা যায়, যা প্রাথমিক সংক্রমণের নির্দেশক। অন্যদিকে, আইজিজি এন্টিবডি প্রায় দুই সপ্তাহ পর থেকে উপস্থিত হতে শুরু করে, যা পুরোনো সংক্রমণের ইঙ্গিত দেয়।
পিসিআর (পলিমেরেজ চেইন রিঅ্যাকশন) টেস্টও ডেঙ্গু নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনগত উপাদান শনাক্ত করা হয়, যা রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ভুলভাবে সংক্রমণ নির্ধারণে সহায়ক। পিসিআর টেস্টের উচ্চ নির্ভুলতা এবং সংবেদনশীলতার কারণে এটি ডেঙ্গু নির্ণয়ে একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
ডেঙ্গুর চিকিৎসা পদ্ধতি
ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রধানত উপসর্গ নির্ভর হয়ে থাকে, কারণ ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে তরল পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে শরীরের পানিশূন্যতা রোধ করা হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি, ফলের রস ও স্যালাইন খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তরল পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে রক্ত চাপ ঠিক থাকে এবং প্লাজমা লিকেজ রোধ করা যায়।
ডেঙ্গু রোগীদের ব্যথা ও জ্বর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্যারাসিটামল ব্যবহৃত হয়। প্যারাসিটামল ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নিরাপদ বেদনানাশক এবং এটি জ্বর কমাতেও সহায়ক। তবে অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।
বিশ্রাম ডেঙ্গু রোগীর সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। পর্যাপ্ত বিশ্রাম শরীরকে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বাড়ায়। রোগীর শারীরিক ও মানসিক বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা মেনে চলতে হবে।
অন্যান্য সহায়ক চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে প্লেটলেট কাউন্ট মনিটরিং অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্লেটলেট কাউন্ট খুব কমে গেলে হাসপাতালাইজেশন এবং প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া রোগীর শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা হলে অক্সিজেন থেরাপি প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং মশা প্রতিরোধক ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে মশারি ব্যবহার, মশা তাড়ানোর ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার এবং বাড়ির আশেপাশে জমা পানি পরিষ্কার রাখা উচিত।
শিশু এবং বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি, কারণ এই দুটি বয়সের মানুষদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে এবং তারা সহজেই গুরুতর অবস্থায় পৌঁছাতে পারে। সঠিক চিকিৎসা এবং সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
গুরুতর ডেঙ্গুর চিকিৎসা
গুরুতর ডেঙ্গু, যেমন ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS), জীবনহানির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। এই অবস্থার জন্য দ্রুত ও কার্যকর চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। গুরুতর ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে, রোগীকে সাধারণত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, যাতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করা যায়।
গুরুতর ডেঙ্গুর চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড (IV) প্রদান। ডিহাইড্রেশন এবং ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে IV ফ্লুইড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক, যা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
রক্ত সঞ্চালন গুরুতর ডেঙ্গুর চিকিৎসায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের কারণে রক্তপাত হতে পারে, যা রোগীর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা হ্রাস করে। এই অবস্থায় রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে রক্তের চাহিদা পূরণ করা হয় এবং রোগীর জীবন রক্ষা করা যায়।
শুধু IV ফ্লুইড এবং রক্ত সঞ্চালন নয়, অন্যান্য জরুরি চিকিৎসাও গুরুতর ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে। প্লাজমা এক্সপান্ডার, অক্সিজেন থেরাপি, এবং ভেন্টিলেটরি সাপোর্ট গুরুতর রোগীদের জন্য প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও, নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা এবং অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়, যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা পরিবর্তন করা যায়।
ডেঙ্গু গুরুতর হলে, চিকিৎসার প্রতিটি ধাপই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হয়। সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসা প্রদান করলে গুরুতর ডেঙ্গু থেকেও রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে কোন ধরণের খাবার খাওয়া উচিৎ
খাদ্য আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক পুষ্টি আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আমাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রধানত প্রোটিন, ভিটামিন, এবং মিনারেল প্রয়োজন হয়।
প্রোটিন আমাদের শরীরের কোষ গঠনে সহায়তা করে এবং শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাছ, মাংস, ডাল, এবং বিভিন্ন ধরনের বাদাম প্রোটিনের ভালো উৎস। এছাড়া, ভিটামিন সি এবং ই আমাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন লেবু, কমলা, আমলকি এবং ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার যেমন বাদাম, বীজ এবং শাকসবজি আমাদের খাদ্য তালিকায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মিনারেল যেমন জিঙ্ক এবং সেলেনিয়ামও প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাংস, শস্য, এবং ডাল শাকসবজি আমাদের খাদ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এছাড়া, সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন বাদাম, শস্য, এবং সামুদ্রিক মাছও আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
শরীরে পানির প্রয়োজনীয়তা পূরণ করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গুর মতো ভাইরাস সংক্রমণের সময় শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে, যা প্রতিরোধ ক্ষমতাকে হ্রাস করতে পারে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত এবং তরল জাতীয় খাবার যেমন ফলের রস এবং সুপ গ্রহণ করা উচিত।
সঠিক পুষ্টি এবং খাদ্য পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা আমাদের শরীরকে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। তাই, সচেতনভাবে আমাদের খাদ্য তালিকায় পুষ্টিকর খাবার যোগ করা প্রয়োজন।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার
ভিটামিন সি আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান যা ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তুলতে সহায়তা করে। এটি একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরের কোষগুলোকে মুক্ত র্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের ভূমিকা অপরিসীম।
কমলা, লেবু, এবং আমলকী প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন সি এর উৎকৃষ্ট উৎস। কমলায় প্রচুর ভিটামিন সি থাকে যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। এছাড়া, লেবুতে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণাবলী যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
আমলকী বা আমলকী একটি অতি পরিচিত ফল যা ভিটামিন সি এর সমৃদ্ধ উৎস হিসেবে পরিচিত। আমলকী নিয়মিত খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ অন্যান্য ফল যেমন স্ট্রবেরি, কিউই, এবং আনারসও ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
অতিরিক্তভাবে, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ শাকসবজি যেমন বিভিন্ন টক স্বাদের ফল , ব্রোকলি, ক্যাপসিকাম এবং পালং শাকও ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। এই সবজি গুলোতে থাকা ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে এবং বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সঠিক পুষ্টি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়। তাই, প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল এবং সবজি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে শরীরের কোষগুলির দ্রুত পুনর্গঠন এবং মেরামতের জন্য প্রোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হয় এবং ডেঙ্গু জ্বরের সময় দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে। প্রোটিন শরীরের টিস্যু পুনর্গঠন করে এবং নতুন কোষ তৈরি করে, যা ডেঙ্গু জ্বরের সময় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ডালের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ডাল সহজলভ্য এবং সহজপাচ্য হওয়ার কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের খাদ্যতালিকায় এটি রাখা উচিত। এছাড়া মাছ একটি অসাধারণ প্রোটিনের উৎস। মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা প্রদাহ কমাতে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
মাংসও প্রোটিনের একটি ভাল উৎস। বিশেষ করে চিকেন এবং লিন বিফের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায়, যা শরীরের কোষ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সহায়ক। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মসলাযুক্ত বা তেলযুক্ত মাংস এড়ানো উচিত।
ডিম একটি পূর্ণাঙ্গ প্রোটিনের উৎস, যার মধ্যে প্রয়োজনীয় সব অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। ডিমের সাদা অংশে প্রচুর প্রোটিন থাকে যা সহজেই হজম হয় এবং শরীরকে শক্তি জোগাতে সহায়ক। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য প্রতিদিন একটি বা দুটি ডিম খাওয়া অত্যন্ত উপকারী হতে পারে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার শরীরের কোষ পুনর্গঠন এবং মেরামতের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, যা দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়ক। সঠিক পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং ডেঙ্গু জ্বরের সময় দ্রুত সুস্থ হওয়া সম্ভব হয়। তাই ডাল, মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাদ্যতালিকায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার ডেঙ্গু প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরকে ফ্রি র্যাডিকালের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। ফ্রি র্যাডিকাল হল এমন ক্ষতিকর অণু যা শরীরের কোষ ও টিস্যুর উপর প্রভাব ফেলতে পারে, এবং ফলে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
বেরি জাতীয় ফল যেমন বেল জাম পেয়ারা আতা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের চমৎকার উৎস। এগুলিতে প্রচুর ভিটামিন সি, ভিটামিন কে এবং ফাইবার থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। এছাড়াও, জামের মধ্যে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন আমাদের দেহের কোষকে ফ্রি র্যাডিকালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
বাদাম যেমন আমন্ড, আখরোট এবং কাজুতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। বিশেষ করে ভিটামিন ই, যা শরীরের কোষকে সুরক্ষা দেয় এবং ইমিউন সিস্টেমকে মজবুত করে। বাদাম খাওয়ার ফলে শরীরে ভালো ফ্যাট ও প্রোটিনের সরবরাহ বাড়ে, যা ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়ক।
সবুজ শাকসবজি যেমন পালং শাক, কুমড়ো এবং উচ্ছে ও অন্যান্য পাতাবাহারী শাক-সব্জিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এগুলিতে থাকা ভিটামিন এ, সি এবং ই শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং দেহের প্রদাহ কমাতে সহায়ক। এছাড়াও, সবুজ শাকসবজিতে থাকা ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস শরীরকে ফ্রি র্যাডিকালের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ করে শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ডেঙ্গুর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। তাই, প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এসব খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
হাইড্রেশন: পর্যাপ্ত পানির গুরুত্ব
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে শরীরের পানিশূন্যতা একটি সাধারণ সমস্যা। ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর এটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রভাব ফেলে এবং রক্তে তরল পদার্থের ঘাটতি সৃষ্টি করে। এই কারণে ডেঙ্গু রোগীদের পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। পর্যাপ্ত পানি পান করলে শরীরে পানিশূন্যতা রোধ করা যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, ফলে ঘাম বের হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় শরীরের অনেকটা পানি বেরিয়ে যায়। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত পানি না পান করলে শরীরের ভেতরের তরল পদার্থের পরিমাণ কমে যেতে পারে, যা ডিহাইড্রেশনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ডিহাইড্রেশন হলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা ডেঙ্গু রোগীর জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত অবস্থায় পর্যাপ্ত পানি পানের মাধ্যমে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করা উচিত। এছাড়াও, তরল জাতীয় খাবার যেমন ফলের রস, স্যুপ, ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস) ইত্যাদি পান করা যেতে পারে। এগুলো শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করবে এবং পানিশূন্যতার ঝুঁকি কমাবে।
এছাড়াও, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন চা, কফি ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এগুলো শরীর থেকে পানি বের করে দেয়। বরং, লেবুর রস, ডাবের পানি, ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানীয় ইত্যাদি গ্রহণ করা উচিত, যা শরীরের পানির মাত্রা সঠিক রাখতে সাহায্য করবে।
সর্বোপরি, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে হাইড্রেশন বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত পানি পানের মাধ্যমে শরীরের পানির মাত্রা ঠিক রাখা এবং পানিশূন্যতা রোধ করা সম্ভব।
ভেষজ ও প্রাকৃতিক প্রতিকার
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভেষজ ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন ভেষজ উপাদান ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ ও উপশমে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তুলসী পাতা, পুদিনা পাতা, পাপাইয়া পাতা, এবং নীম পাতা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
তুলসী পাতা: তুলসী পাতার অ্যান্টি-ভাইরাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে, যা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সহায়ক। তুলসী পাতা চায়ের সাথে মিশিয়ে পান করা যেতে পারে। এছাড়া তুলসী পাতার রস সরাসরি পান করাও উপকারী হতে পারে।
পুদিনা পাতা: পুদিনা পাতায় রয়েছে মেন্থল, যা শরীরকে শীতল করে এবং ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলি হ্রাস করে। পুদিনা পাতা চায়ের সাথে মিশিয়ে বা সরাসরি চিবিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া পুদিনা পাতার রসও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সহায়ক।
পেঁপে পাতা: পেঁপে পাতায় রয়েছে প্যাপেইন এবং কারিকিন এনজাইম, যা রক্তে প্লাটিলেট সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর রক্তে প্লাটিলেট সংখ্যা কমে যায়, তাই পেঁপে পাতার রস খুবই উপকারী। পেঁপে পাতার রস সরাসরি পান করে অথবা মধুর সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়।
নীম পাতা: নীম পাতায় অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে, যা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর। নীম পাতা চায়ের সাথে মিশিয়ে পান করা যেতে পারে বা সরাসরি চিবিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
এছাড়া, আদা, রসুন, হলুদ, এবং কালোজিরা ইত্যাদি ভেষজ উপাদানও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। এই উপাদানগুলির নিয়মিত ব্যবহারে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ডেঙ্গুর প্রভাব কমে যায়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়ক।
প্রথমত, প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিত। ডেঙ্গু হলে দেহে পানির অভাব দেখা দেয় এবং ডিহাইড্রেশন হতে পারে। তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানীয় পান করা প্রয়োজন। এছাড়াও, তাজা ফল ও সবজি খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই খাবারগুলো ভিটামিন সি ও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদানে সমৃদ্ধ, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, মাংস, ডাল, ও বাদাম খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। প্রোটিন শরীরের কোষ গঠনে সহায়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া, শর্করা ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন চাল, রুটি, ও ওটমিল খাওয়া উচিত। এই খাবারগুলো শরীরকে শক্তি প্রদান করে এবং হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।
সুস্থ জীবনধারা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গুর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা উচিত। এছাড়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। ব্যায়াম শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ডেঙ্গু প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘরের আশেপাশে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলা উচিত, কারণ এডিস মশা এই পানিতে বংশবিস্তার করে। এছাড়া, মশারি ব্যবহার করা, মশা তাড়ানোর ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করা, এবং পূর্ণাঙ্গ কাপড় পরিধান করা উচিত।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখার মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমরা ডেঙ্গুর ঝুঁকি কমাতে পারি। এভাবে আমরা নিজেকে ও আমাদের প্রিয়জনকে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা করতে পারি।