ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, ইসরোর ‘আর্থ অবজারভিং স্যাটেলাইট ৬’ বা ‘ওশানস্যাট-৩’, সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা জীবনের জটিল বিষয় গুলোকে সামনে এনেছে। মহাদেশের মরশুমী রঙ বদল থেকে শুরু করে সমুদ্রের গভীরে ক্লোরোফিল-সমৃদ্ধ ফুলের গতিশীল ঘূর্ণন,– পৃথিবীর এই প্রাণবন্ত ইকোসিস্টেমের বিস্ময়কর জগতকে স্পষ্টভাবে তুলে এনেছে এই উপগ্রহ।
‘ওশানস্যাট -৩’-এর মূল চালিকাশক্তি হল ‘ওশান কালার মনিটর’ বা ‘ওসিএম-৩’ যা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন একটি যন্ত্র। এর সাহায্যে পৃথিবীর গাছপালা বা উদ্ভিজ জগত এবং সমুদ্রের গভীরের উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ সম্পর্কিত যাবতীয় খুঁটিনাটি খুব নিখুঁতভাবে বোঝা যায়। নরমালাইজড ডিফারেন্স ভেজিটেশন ইনডেক্স’ (NDVI)-এর মাধ্যমে স্যাটেলাইটটি বিশাল আকারের ভূখণ্ডজুড়ে কতটা সবুজ জীবন রয়েছে, তার একটা ধারণা দেয়। সবুজাভ বৃদ্ধি এবং গাছপালার সুস্থতার বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য এই সূচকটি খুবই জরুরি।
সমুদ্রের অনেক গভীরে ওশানস্যাট-৩ এর দ্বারা ফাইটোপ্লাঙ্কটন ক্লোরোফিল কতটা ঘন তাও মাপা সম্ভব হয়েছে । এই অতি ক্ষুদ্র, জীবগুলো সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের একেবারে মূল ভিত্তি, কিন্তু এদের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য সাধারণত আমরা শুনতে পেতাম না।তবে ওশানস্যাট-৩ র কল্যাণে ফাইটোপ্লাঙ্কটন সম্পর্কে একটা ঝকঝকে ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়েছে বর্তমান সময়ে। সামুদ্রিক খাদ্য জালের একেবারে মূলেই থাকে এই ফাইটোপ্লাঙ্কটন।এবং এদের সূর্যালোককে জীবন-ধারণকারী রাসায়নিক শক্তিতে বদল করার একটা অসাধারণ ক্ষমতা ও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ধরা পড়েছে।তবে আশ্চর্য বিষয় হলো এই বিশেষ ক্ষমতা মূলত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্তই তীব্র থাকে। সমুদ্রের সঞ্চালনের ফলে এই সময়ে ফাইটোপ্লাঙ্কটনের সংখ্যা ও খুব বেড়ে যায়।
ওশানস্যাট-৩ তে আছে ‘স্ক্যাটারোমিটার’ বা ‘SCAT-3’ যন্ত্র যা সারা পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের বাতাসের বেগ এবং দিক সম্পর্কে খুবই যথাযথ তথ্য দেয়। সমুদ্রের গভীরে জীবনের জৈবভূ-রাসায়নিক পরস্পরনির্ভরশীলতা বোঝার জন্য, এমনকি ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম সম্পর্কে জানতেও এই যন্ত্র খুব সাহায্য করে।
হায়দ্রাবাদে অবস্থিত ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টার (NRSC), এই সকল তথ্যের বিশদ বিশ্লেষণও করেছে।
ওশানস্যাট-৩ মহাকাশযান থেকে বেশ কিছু চলমান ছবি পাওয়া গেছে । সেই ছবিগুলোতে সবুজ মহাদেশের বাদামী হয়ে যাওয়া বা আবার সবুজ হতে থাকার ছন্দময় খেলা, সঙ্গে সমুদ্রের ক্লোরোফিল ফুলের মনোরম চলাচল, এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত প্রকৃতির গতিশীল ক্যানভাস তুলে ধরেছে।
ইসরো’র এই অসামান্য কাজ সামুদ্রের উচ্চ উৎপাদনশীল অঞ্চলগুলোকেও খুঁজে বার করেছে। পৃথিবীর ক্রান্তীয় অঞ্চলের বাইরে, নিরক্ষরেখা-সংলগ্ন অঞ্চল- যাকে ‘এক্সট্রাট্রপিক্যাল জোন’ বলে, এবং উপকূলীয় উন্মুক্ত অঞ্চলে অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে ফাইটোপ্লাঙ্কটন খুব বৃদ্ধি পায় বলে এই স্যাটেলাইট দেখিয়েছে, তার কারণ শক্তিশালী বাতাসের সঞ্চালনের ফলে সমুদ্রের গভীরের জল ওপরে ওঠে আসে। এছাড়াও, বায়ুর গতিবিধি খুঁটিয়ে দেখার ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চলে কীভাবে ট্রপিক্যাল ইস্টারলিজ একত্রিত হয়, এবং ভারত মহাসাগরের মৌসুমী বায়ুর গতি-প্রকৃতিও এই স্যাটেলাইট থেকে তা জানা যায়।
ইসরো-র ওশানস্যাট-৩ শুধু একটা স্যাটেলাইট নয়, পৃথিবীর জীবনশক্তির একটা উন্মুক্ত জানালাও বটে। এর অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি পৃথিবীর জৈবমণ্ডল সম্পর্কে আমাদের বোধকে একেবারে বদলে দিয়েছে। এবং মাটি, সমুদ্র এবং বায়ুমণ্ডলের পারস্পরিক নির্ভরতা যে কতটা সূক্ষ্ম সে সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।