যৌবনকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা মানুষের আজকের নয় । মানুষের সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ যৌবনকে বশ করতে চেয়েছে , পরাজিত করতে চেয়েছে জরাকে । পৃথিবীর সমস্ত মিথোলজি আল লৌকিক আখ্যানে এর ভুরি ভুরি নিদর্শন আছে ।
কিন্তু যৌবনকে স্থায়ী করে দেবার কোনো মন্ত্রই মানুষ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি । যৌবনকে স্থির করে দেবার মন্ত্র না থাকলেও প্রকৃতিতে এমন অনেক উপাদানই আছে যে গুলি আমাদের যৌবন কে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে ।
তেমনই এক উপাদান হল আখের গুড় । একটা সময়ে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এই বস্তুটির উপস্থিতি থাকলেও কালের নিয়মে অন্যান্য ঔপনিবেশিক খাবারের চাপে হারাতে বসেছে এই অমূল্য খাবারটি। এককালের বাঙালীর প্রিয় গুড় আজ বাঙালীর কাছেই ব্রাত্য ।
আখের রস থেকে তৈরি খাঁটি গুড়ের শুধুই অসাধারণ স্বাদ তাই নয়, নানা গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত গুড় খেলে তা বার্ধক্যকে রুখতে পারে। তাই সাদা চিনির থেকে স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আবার ফিরিয়ে আনতে হবে গুড়কে ।
আখের গুড়ের পুষ্টিগুণ
আখের রসকে প্রক্রিয়াজাত করার সময় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় না বলে খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মত গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিগুণ গুড়ের মধ্যে থেকে যায়। গুড় আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ। এসব উপাদান আমাদের দেহের জন্য খুবই উপকারী। নিয়মিত গুড় খেলে সুস্থ থাকা যায় আর দীর্ঘজীবন লাভ করা যায়।
বার্ধক্য রোধে আখের গুড়ের উপকারিতা
আমরা যত বড় হই আমাদের শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহের মাত্রা বাড়তে থাকে। গুড়ে যেসব অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যেমন পলিফেনল এবং ফ্ল্যাভোনয়েড আছে, তা ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দেয়। ফ্রি র্যাডিক্যাল সেলুলার বিপাকের ক্ষতিকর উপজাত যা বার্ধক্য এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য দায়ী। “জার্নাল অফ এথনোফার্মাকোলজি” তে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গুড়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্যভাবে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়। এটি আমাদের শরীরের কোষের ক্ষয় রোধ করতে ও বার্ধক্যকে দেরিতে আসতে সাহায্য করে।
হাড়ের স্বাস্থ্যরক্ষায় আখের গুড়
গুড়ে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস রয়েছে, যা আমাদের হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে ও হাড়কে শক্তিশালী করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ের ঘনত্ব কমতে থাকে, যার ফলে অস্টিওপরোসিসের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিয়মিত গুড় খেলে এই সমস্যা এড়ানো যায় এবং বৃদ্ধ বয়সেও হাড় মজবুত থাকে। “ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ফুড সায়েন্সেস অ্যান্ড নিউট্রিশন”-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গুড় সমৃদ্ধ খাবার খেলে হাড়ের খনিজ ঘনত্ব উন্নত হয়।
ডিটক্সিফিকেশন
গুড়ের আরেকটি উপকারিতা হলো এটি আমাদের শরীর, বিশেষ করে যকৃত বা লিভারকে বিষাক্ত পদার্থমুক্ত করতে সহায়তা করে। নিয়মিত গুড় খেলে যকৃতের ক্ষতিকর টক্সিন পরিষ্কার করতে এবং এর সার্বিক কার্যকারিতা উন্নত করতে ভূমিকা রাখে। যকৃৎ যথাযথভাবে কাজ করলে আমরা সুস্থ থাকি এবং তা আমাদের আয়ু বৃদ্ধিতেও সহায়ক। “জার্নাল অফ ন্যাচারাল রেমেডিস”-এর এক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, নিয়মিত গুড় খেলে লিভারের বিভিন্ন সমস্যা দূর হয়।
পরিপাক স্বাস্থ্যে আখের গুড়
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের পরিপাক ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। গুড় পাচক এনজাইমগুলিকে উদ্দীপিত করে, যা পরিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে এবং বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়। এটি পুষ্টির সঠিক শোষণ নিশ্চিত করতেও সাহায্য করে যা বয়স্কদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আখের গুড়ের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা এক ঝলকে
উপাদান | পরিমাণ (১০০ গ্রামে) | উপকারিতা |
---|---|---|
ক্যালোরি | ৩২১ কিলোক্যালোরি | শক্তি সরবরাহ করে |
প্রোটিন | ০.৪ গ্রাম | পেশীর মেরামতে সাহায্য করে |
ফ্যাট | ০.১ গ্রাম | মিনিমাম ফ্যাট থাকার ফলে স্বাস্থ্যকর |
কার্বোহাইড্রেট | ৭৯.৮ গ্রাম | দীর্ঘমেয়াদী শক্তি সরবরাহ করে |
ফাইবার | ০.৪ গ্রাম | হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে |
ক্যালসিয়াম | ৪০-৭০ মিলিগ্রাম | হাড় মজবুত করে এবং দাঁতের স্বাস্থ্য উন্নত করে |
আয়রন | ৪-৬ মিলিগ্রাম | হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সাহায্য করে, অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে |
পটাশিয়াম | ৬০০ মিলিগ্রাম | হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য বজায় রাখে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে |
ম্যাগনেশিয়াম | ৯০ মিলিগ্রাম | মাংসপেশী ও নার্ভ সিস্টেমের স্বাস্থ্য উন্নত করে |
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট | বিভিন্ন পরিমাণে থাকে | কোষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে |
ভিটামিন B (থায়ামিন) | ০.১০ মিলিগ্রাম | এনার্জি মেটাবোলিজম বৃদ্ধি করে এবং নার্ভ সিস্টেমের স্বাস্থ্য রক্ষা করে |
কতটুকু গুড় খাওয়া যেতে পারে?
গুড় হল চিনির তুলনায় অনেক পুষ্টিকর হলেও, মনে রাখতে হবে যে এটিও এক ধরণের চিনি। সেজন্য স্বাস্থ্যবিদদের মতে চিনির পরিবর্তে গুড় ব্যবহার করা উচিত, চিনির উপর গুড় খাওয়া উচিত নয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দিনে ১০-১৫ গ্রাম গুড় খাওয়া নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়।
প্রতিদিন গুড় খাওয়া বার্ধক্য রোধের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। এর সমৃদ্ধ পুষ্টিগুণ শুধু আপনার খাবারের স্বাদই বাড়ায় না, সার্বিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও সাহায্য করে। যেসব রোগ বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেখা দেয় তা প্রতিরোধ করতেও গুড়ের ভূমিকা রয়েছে। তবে যেকোন খাবারের ক্ষেত্রেই পরিমিতি বজায় রাখা জরুরি। যেসব ব্যক্তির ডায়াবেটিস বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, নতুন কিছু খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।