ইতিহাসের পাতা আর লোকগাথায় রাজা সলোমনের লুকানো ধনভাণ্ডারের গল্প আমাদের চিরকাল কল্পনাকে উসকে দিয়েছে। দশম শতাব্দীতে ইজরায়েলের শাসক, জ্ঞান আর অগাধ সম্পদের প্রতীক রাজা সলোমনের রাজত্ব এক স্বপ্নের মতো। তাঁর ধনরত্নের সন্ধান এখনও চলে চুড়ান্ত রহস্যে মোড়া তাঁর এই ধনসম্পদ আমাদের অনন্ত জিজ্ঞাসাকে বারে বারে জাগিয়ে তুলেছে ।
বলা হয়, রাজা সলোমনের সাম্রাজ্য ছিল বিশাল, তাঁর সম্পদের ভাণ্ডার ছিল অসীম । তাঁর রাজকোষে জমা হতো সুদূর দেশের রত্ন, অফিরের সোনা, আর সমস্ত সামন্ত রাজাদের পাঠানো উপঢৌকন। জেরুজালেমের ‘সলোমন’স টেম্পল’ ধর্মীয় কেন্দ্র হওয়ার পাশাপাশি এই বিপুল সম্পদের আঁতুড়ঘর ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যের পতনের সাথে সাথে রহস্য হয়ে গেল এই অর্থভাণ্ডারের হদিশ। রয়ে গেল শুধু এক চিরসবুজ ধাঁধা যা বহু যুগ ধরে সম্পদ-শিকারি আর পণ্ডিতদের মনে কৌতূহল তৈরি করে।
সন্ধানের পথ
রাজা সলোমনের ধনভাণ্ডার খোঁজার কাজ মোটেই সহজ নয়। ঐতিহাসিক দলিল, ধর্মীয় গ্রন্থের বিবরণ আর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ—এই জটিল বুনোটের মাঝে নাকি লুকিয়ে আছে গুপ্তধনের সূত্র। কেউ বলে, টেম্পল মাউন্টের নীচের গোপন কুঠুরিতে এই ধনভাণ্ডার আছে, কারও মতে, আক্রমণ থেকে বাঁচাতে তা ছড়িয়ে রাখা হয়েছিল গোটা রাজ্যে।
এই রহস্যের খোরাক জোগায় বহু বছরের পুরনো নানান রহস্যময় মানচিত্র আর ধনভাণ্ডারের অলৌকিক ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে এমন নানা স্ক্রল। কিংবদন্তিতে আছে, ‘সলোমনের সিল’ নামের এক জাদু আংটির কথা যা নাকি দৈত্য আর আত্মাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। অনেকে বিশ্বাস করে, এই আংটি দিয়েই তিনি তাঁর ধনভাণ্ডারের রক্ষাকবচ বানিয়েছিলেন। বাস্তব আর লোককথার এই মিশেল , সারা বিশ্ব জুড়ে পাগল করে তোলে ইতিহাস-প্রেমী আর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়দের।
গুপ্তধন রক্ষক
গুপ্তধনের গল্প থাকলে থাকবে রক্ষকের গল্পও । মধ্যযুগের খ্রিস্টান সম্প্রদায় ‘নাইটস টেম্পলার’ এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক রটনা। ক্রুসেডের সময় নাকি তারা রাজা সলোমনের গুপ্তধন উদ্ধার করেছিল আর সেই দিয়ে নিজেদের কার্যকলাপ চালাত, এর অবস্থান শুধু সম্প্রদায়ের উচ্চপদস্থ কয়েকজন জানত। আবার অনেকের ধারণা, রাজা সলোমনের গুপ্তধন রক্ষকেরা কোনও গুপ্ত সমাজ হতে পারে যেখানে এই ধনভাণ্ডার লুকানো হয়েছে সবার চোখের আড়ালে, অযোগ্যদের অনধিকার চর্চা আটকাতে।
আধুনিক অনুসন্ধান
উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি আর ডিজিটাল আর্কাইভের যুগে রাজা সলোমনের ধন-সম্পদ খোঁজার কাজ নতুন গতি পেয়েছে। সর্বশেষ প্রযুক্তি হাতিয়ার হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক আর অভিযাত্রীদের। হাজার বছরের ধরে লুকিয়ে থাকা সূত্র খুঁজতে তছনছ করে দেওয়া হচ্ছে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আর অচেনা গুহা। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত রাজার ধনভাণ্ডার মরীচিকার মতোই দুর্লভ, ব্যর্থ অভিযানের পর অভিযান চালিয়ে আরও বাড়ছে রহস্যময় কিংবদন্তির রহস্য।
রাজা সলোমনের ধনভাণ্ডার পাওয়ার মোহ হয়তো শুধুই অর্থ-লোভে নয়। এই অভিযান আমাদের নিয়ে যায় ইতিহাসের গহীনে, জ্ঞান আর বিলাসবহুল এক অতীতের দিকে ইশারা করে। সম্পদ খুঁজতে গিয়ে আমাদের কাছে উন্মোচিত হয় এক আশ্চর্য জগৎ।
অমূল্য সম্পদ
সম্ভবতঃ রাজা সলোমনের আসল ধনভাণ্ডার আদৌ কোনও লুকানো সোনা-রূপার ভাণ্ডার নয়, বরং তাঁকে কেন্দ্র করে রচিত নানা গল্প, শিক্ষা আর রহস্যেদের সমষ্টি। তাই এই ধনভাণ্ডার খুঁজতে গিয়ে আসলে আমরা তলিয়ে দেখি মানব ইতিহাস আর আধ্যাত্মিকতার জগৎকে।
প্রাচীন পুণ্যভূমিতে সূর্য যখন অস্ত যায়, তখনও চলতে থাকে রাজা সলোমনের লুকানো ধনভাণ্ডার খোঁজার নেশা। কিংবদন্তির শক্তি আর অজানাকে জানার অদম্য আকাঙ্ক্ষার এক অমোঘ প্রমাণ হয়ে ওঠে এই চিরন্তন অভিযান। তাই মাটির নীচে বা সমুদ্র তলে নয়, স্বপ্নদর্শী আর অসাধারণের সন্ধানীদের হৃদয়ে আর মনে লুকিয়ে আছে আসল ধনভাণ্ডার।