এলাহাবাদ হাইকোর্ট সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাসা আইন ২০০৪-কে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছে, এই আইনের মাধ্যমে রাজ্যের মাদ্রাসাগুলি পরিচালিত হতো। কোর্টের মতে, এই আইন ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন করে। রায়ের ফলে প্রায় ১০,০০০ মাদ্রাসা শিক্ষক এবং ২৬ লক্ষেরও বেশি মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারকে আদালত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের এই বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের সরকারি বিদ্যালয়ে স্থানান্তরের জন্য পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে যথেষ্ট সংখ্যক অতিরিক্ত আসন তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনে এই ছাত্রদের উপযুক্ত পঠন পাঠনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক নতুন স্কুলও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মাদ্রাসা সমিতিগুলি জানিয়েছে যে তারা সুপ্রিম কোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করবে।
উত্তর প্রদেশে ১৬,৫১৩টি স্বীকৃত মাদ্রাসা রয়েছে, যার মধ্যে ৫৬০টি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এবং ৮,৪০০-এরও বেশি সরকারের স্বীকৃতি ছাড়া খারিজী মাদ্রাসা রয়েছে। উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ জাভেদ জানান, হাই কোর্টের এই সিদ্ধান্ত সরকার স্বীকৃত মাদ্রাসায় ১৯.৫ লক্ষ এবং খারিজী মাদ্রাসায় ৭ লক্ষ মোট ২৬ লক্ষেরও বেশি ছাত্রছাত্রীকে প্রভাবিত করবে ।
হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ আইনটিকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেওয়ার সময় বলেছে যে, মাদ্রাসা গুলি আধুনিক শিক্ষা প্রদানে ‘অস্বীকৃতি’ জানায় এবং শিক্ষার মান ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সের সমস্ত শিশুর বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার সাংবিধানিক নিয়মকে লঙ্ঘন করে।
আইনজীবী অংশুমান সিংহ রাঠোরের দায়ের করা একটি আবেদনের উপর ভিত্তি করে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এই রায় দিয়েছে। তিনি আদালতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে মাদ্রাসা আইন ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন করেছে এবং সংবিধানের ২১-ক অনুচ্ছেদে বাধ্যতামূলকভাবে যেমন প্রয়োজন ছিল তেমন ১৪ বছর বয়স অবধি বা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত মানসম্পন্ন বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। রাঠোর আরও যুক্তি দিয়েছিলেন যে মাদ্রাসা আইন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা সমস্ত শিশুদের জন্য সার্বজনীন এবং মানসম্পন্ন বিদ্যালয় শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে।
৮৬ পৃষ্ঠার রায়ে হাইকোর্ট জানিয়েছে যে মাদ্রাসা আইন “ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন করেছে, যা সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি অংশ”। আদালত বলেছে যে এই আইন সংবিধানের ১৪, ২১ এবং ২১-ক অনুচ্ছেদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন, ১৯৫৬-এর ২২ ধারা লঙ্ঘন করেছে।
বেঞ্চটি ১ম থেকে ১২শ শ্রেণি পর্যন্ত মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম বিশ্লেষণ করার পরে আরও উল্লেখ করেছে যে মাদ্রাসা আইনের অধীনে শিক্ষা “নিশ্চিতভাবেই রাজ্য বোর্ড দ্বারা স্বীকৃত অন্যান্য নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত শিক্ষার সমতুল্য নয়।” এলাহাবাদ হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ করেছে যে মাদ্রাসায় ১ম থেকে ৮ম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে “ ভাষা অধ্যয়নের পাশাপাশি প্রতিটি ক্লাসে ইসলাম অধ্যয়ন করা আবশ্যক এবং একজন ছাত্র ধর্ম শাস্ত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে পরবর্তী ক্লাসে উন্নীত হতে পারে না”।
অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে কোরআন এবং ইসলাম ১ম থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে পড়ানো হয়। ১০ম শ্রেণীতে (মৌলভী বা মুনশী) ধর্মতত্ত্ব সুন্নি এবং ধর্মতত্ত্ব শিয়া বাধ্যতামূলক বিষয় এবং গণিত, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান (শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য), যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন, সমাজবিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের মধ্যে থেকে একটি ঐচ্ছিক বিষয় নিতে হতো। দ্বাদশ শ্রেণিতে (আলিম) ধর্মতত্ত্ব (সুন্নি এবং শিয়া উভয়ই) বাধ্যতামূলক বিষয় এবং হোম সায়েন্স (শুধুমাত্র মেয়েদের), হিন্দি, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান এবং টাইপিং এর মধ্যে থেকে একটি ঐচ্ছিক বিষয় বেছে নিতে হতো।
অল ইন্ডিয়া টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন, মাদরাসা আরাবিয়ার জাতীয় সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুল্লাহ খান জানান, মাদ্রাসাগুলি কেবল ধর্মীয় শিক্ষা প্রচারের জন্য চালানো হচ্ছে না এবং সেই উদ্দেশ্যে অনুদানও পাচ্ছে না। প্রাচ্য ভাষা (আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত) উন্নয়নের জন্য অনুদান দেওয়া হয়। একমাত্র পার্থক্য হল যে বৈদিক বিদ্যালয়গুলি রাজ্য শিক্ষা দপ্তর দ্বারা পরিচালিত হয়, আর মাদ্রাসাগুলি ১৯৯৬ সাল থেকে সংখ্যালঘু বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। তিনি আরও যোগ করেছেন যে আরবি-ফারসি বোর্ড পরে মাদ্রাসা বোর্ড হয়ে যায়। আমাদের সিলেবাসে আমরা আধুনিক শিক্ষা প্রদান করি। এবং সমস্ত বিষয় পড়ানো হয় । এমনকি হিন্দু শিক্ষক এবং ছাত্ররাও মাদ্রাসায় পড়ান এবং পড়াশোনা করেন।
তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা মাদ্রাসার লক্ষ্য নয়, কিন্তু ভাষাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং তাদের মর্যাদা রক্ষা করাটাও আমাদের কর্তব্য ।
রাজ্যের প্রেক্ষাপটে মাদ্রাসার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে জাভেদ বলেন, যেসব জায়গায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পৌঁছাতে আরও অনেক বছর লেগে যাবে সেখানে অনেক মাদ্রাসা চলছে। এমন জায়গা আছে যেখানে দরিদ্র মানুষ তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠায়, যা দান এবং যাকাতের মাধ্যমে তাদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করে। এগুলো বন্ধ করে দিলে নিরক্ষরতার হার বাড়বে ।
আদালতের রায় মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্যও সংকট তৈরি করেছে। বলরামপুরের একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ফাইয়াজ আহমেদ মিসবাহি , যিনি গত নয় বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন, তিনি আশঙ্কা করেন যে এলাহাবাদ হাইকোর্ট র রায় তাকে এবং হাজারো শিক্ষককে চাকরি ছাড়া করতে পারে। তিনি আদালতের শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নীরবতা দেখেও উদ্বিগ্ন। মিসবাহি উল্লেখ করেছেন যে এলাহাবাদ হাইকোর্ট মাদ্রাসার ছাত্রদের পুনর্বাসনের কথা বলেছে, কিন্তু শিক্ষকদের ব্যাপারে চুপ । শিক্ষকদের কি হবে? তাদের কোন কাজ থাকবে না, কোন বেতন থাকবে না !
আদালত সরকারকে ২০০৪ সালের আইনের যে অংশগুলিকে অসাংবিধানিক বলে মনে করে তা সংশোধন করার নির্দেশ দিতে পারত। মাদ্রাসায় আমরা বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করি এবং খাবার ও চিকিৎসার সুবিধাও দিই। ধর্মীয় শিক্ষাই কেবল আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ২০১৮ সাল থেকে, আমরা NCERT-এর বই এবং সেই সিলেবাস অনুসারে পড়াচ্ছি।
মাদ্রাসার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা মনে করেন যে আদালতের মূল্যায়ন যে মাদ্রাসাগুলি মানসম্পন্ন এবং সার্বজনীন শিক্ষা প্রদানে পিছিয়ে আছে তা সঠিক নয়। মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় পড়াশোনা করা অসংখ্য লোক আছেন যারা সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় পাশ করে আইএএস অফিসার হয়েছেন। অন্যরা আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করছেন এবং মেডিকেল প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করছেন । অনেক মাদ্রাসা-শিক্ষিত ব্যক্তি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হচ্ছেন। যদি আমরা সামগ্রিকভাবে মানসম্পন্ন শিক্ষার কথা বলি, তাহলে কি সরকারি স্কুলের সব ছাত্রই সফল হচ্ছে? যদি তাই হত, তাহলে এত বেকারত্ব কেন?
মাদ্রাসা আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার সময়, এলাহাবাদ হাইকোর্ট বলেছে যে রাজ্য বিভিন্ন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রদান করে বৈষম্য করতে পারে না। রাজ্যের পক্ষে এই ধরনের পদক্ষেপ শুধুমাত্র অসাংবিধানিক নয়, ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে সমাজকে বিভক্ত করে তোলে। রাজ্যের যে কোনো নীতি যা ধর্মীয় ভিত্তিতে সমাজকে বিভক্ত করে তা সাংবিধানিক নীতির লঙ্ঘন।
উত্তরপ্রদেশ সরকার এবং মাদ্রাসা বোর্ড আইনটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার আবেদনের বিরোধিতা করে যুক্তি দিয়েছিল যে রাজ্য সরকারের প্রথাগত শিক্ষা সহ শিক্ষা সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে, যার মধ্যে ধর্মও অন্তর্ভুক্ত। তারা যুক্তি দিয়েছিল যে রাষ্ট্র সংবিধানের সপ্তম তফসিলের তালিকা III-এর অন্তর্গত ২৫ নং ধারার অধীনে তার ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য মাদ্রাসা আইন প্রণয়ন করেছে।
বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের রাজ্যের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েও এলাহাবাদ হাইকোর্ট জোর দিয়ে বলেছে যে এই ধরনের শিক্ষাকে অবশ্যই “ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতির” হতে হবে। বেঞ্চটি আরও বলেছে যে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম ও তার সাথে যুক্ত দর্শনের জন্য শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় শিক্ষা বোর্ড তৈরি করার বা বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করার কোন ক্ষমতা রাজ্যের নেই।