আমাদের নিজেদের অজান্তেই আমাদের নিঃশ্বাস সামাজিক মেলামেশায় একটা বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু এই নিঃশ্বাস যদি সুগন্ধী না হয়, তাহলে কী বিব্রতকর পরিস্থিতি! মুখের দুর্গন্ধ বা হ্যালিটোসিস শুধু লজ্জার কারণই নয়, এর পেছনে নানান কারণ থাকতে পারে – আমাদের মুখের পরিচ্ছন্নতার অভাব, কী খাচ্ছি, এমনকি শারীরিক সমস্যাও। তাহলে কেন এই দুর্গন্ধ হয়? আর এর মোকাবিলায় সবচেয়ে সহজ, কিন্তু উপকারী, উপায় কী?
দুর্গন্ধের কারণ
মুখের দুর্গন্ধের পেছনে নানান কারণ থাকতে পারে:
- মুখের পরিচ্ছন্নতার অভাব: খাবারের টুকরো মুখে পড়ে থাকলে তা পচে গিয়ে দুর্গন্ধ তৈরি করে। তৈরি হয় নানান ব্যাকটেরিয়া।
- খাদ্যাভ্যাস: রসুন, পেঁয়াজ, বা ঝাল মসলা যুক্ত খাবার খেলে তা রক্তে মিশে যায়, পরে ফুসফুসের মাধ্যমে নিঃশ্বাসে বেরিয়ে এসে দুর্গন্ধ ছড়ায়।
- ধূমপান: তামাক শুধু শরীরের জন্যই ক্ষতিকর নয়, মুখের দুর্গন্ধের একটা বড় কারণ।
- মুখ শুকিয়ে যাওয়া: লালা মুখকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। মুখ শুকিয়ে গেলে তা দুর্গন্ধের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
- শারীরিক সমস্যা: কখনও কখনও দীর্ঘস্থায়ী সাইনাসের সমস্যা, ডায়াবেটিস, লিভার বা কিডনির সমস্যা থেকেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে।
সবথেকে কার্যকরী সমাধান
মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য ব্রাশ করা বা ফ্লস করার কথা সবাই বলে, কিন্তু জিভ পরিষ্কার করা স্ক্রাপিং করার ( জিভ ঘষা) কথা অনেকেই জানে না। জিভের খসখসে পৃষ্ঠ আর উষ্ণ, আর্দ্র পরিবেশ ব্যাকটেরিয়ার জন্য আদর্শ জায়গা।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের এক প্রাচীন নিয়ম হল জিভ ঘষা। এই সহজ কাজটা দুর্গন্ধ তাড়ানোর সাথে সাথে আমাদের মুখের সার্বিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতেও ভীষণ উপকারী। কেন জিভ ঘষা এত কার্যকরী?
- ব্যাকটেরিয়া কমায়: নিয়মিত জিভ স্ক্রাপিং করলে দুর্গন্ধের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা অনেক কমে যায়।
- স্বাদবোধ বাড়ায়: জিভের আবরণ পরিষ্কার হলে আমাদের খাবারের স্বাদ বুঝতেও সুবিধা হয়।
- মুখের সার্বিক সুস্বাস্থ্য: ব্যাকটেরিয়া কমে যাওয়ায় দাঁতে প্লাক জমা, মাড়ির রোগ, বা দাঁত ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কমে যায়।
- সহজ এবং দ্রুত: স্ক্রাপিং করতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগে, অথচ তার উপকার সারাদিন থাকে।
কীভাবে জিভ স্ক্রাপিং করবেন ?
- জিভ ঘষার যন্ত্র: প্লাস্টিক, স্টেনলেস স্টিল, বা তামার তৈরি জিভ ঘষার যন্ত্র পাওয়া যায়। নিজের সুবিধা মত যেটা ভালো লাগে এবং পরিষ্কার করা সহজ সেটা বাছুন।
- আলতো করে ঘষুন: দাঁত ব্রাশ ও ফ্লস করার পর মুখ খুলে, জিভ বাইরে বার করে, জিভ ঘষার যন্ত্রটা জিভের পেছনের দিকে রাখুন। তারপর আলতো করে সামনের দিকে টেনে আনুন। এতে জিভের উপরের সাদা বা রঙিন আস্তরণ উঠে যাবে। প্রতিবার ঘষার পর যন্ত্রটা ধুয়ে নিন।
- প্রয়োজন মত করুন: সাধারণত ৫-১০ বার ঘষাই যথেষ্ট। তবে খুব জোরে ঘষবেন না, তাতে জিভে আঘাত লাগতে পারে।
যদি এর পরেও সমস্যা থেকে যায় তবে এই বিষয় গুলিতেও মনোযোগ দিন :
- মুখের পরিচ্ছন্নতা: দিনে দুবার ব্রাশ করা, প্রতিদিন ফ্লস করা, এবং জিভ পরিষ্কার করা দুর্গন্ধ হ্রাস করতে অনেকটাই সাহায্য করে। নরম ব্রাশ এবং ফ্লোরাইড বা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান যুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার বিশেষ উপকারী।
- পর্যাপ্ত জলপান: বেশি করে জল খেলে তা লালা উৎপাদন বাড়ায়, যা প্রাকৃতিকভাবেই মুখ থেকে ব্যাকটেরিয়া বা খাবারের কণা ধুয়ে পরিষ্কার রাখে।
- খাদ্যাভ্যাসে নজর রাখুন: কোন খাবারে আপনার মুখে দুর্গন্ধ বেশি ছড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখুন, সেই খাবার কমিয়ে দিন। আর তার বদলে বেশি করে কুড়মুড়ে ফল বা সবজি খান, এগুলো দাঁত পরিষ্কার করতেও সাহায্য করেরে।
- ধূমপান বর্জন করুন: অসংখ্য শারীরিক উপকার ছাড়াও, ধূমপান ছাড়লে আপনার নিঃশ্বাসের মান অনেক উন্নত হতে বাধ্য।
- নিয়মিত দাঁতের ডাক্তারের কাছে যান: দাঁত স্কেলিং করানো ছাড়াও দাঁতের গুড়িতে কোনো সমস্যা কিংবা শুষ্ক মুখের কারণ বা চিকিৎসা সম্পর্কে ডেন্টিস্ট পরামর্শ দিতে পারেন।
উপরের বিষয়গুলি মেনে চলার পরেও যদি মুখের দুর্গন্ধ চলে না যায়, তাহলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দাঁতের ডাক্তারেরা মুখের কোনো নির্দিষ্ট সমস্যা খুঁজে পেতে পারেন। অন্যদিকে চিকিৎসকরা দেখতে পারেন আপনার অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতা আছে কিনা। অনেক সময়ে সমস্যার জন্য শুধু জীবনযাত্রায় বদলই যথেষ্ট নয়, ওষুধেরও প্রয়োজন পড়তে পারে।
মুখের দুর্গন্ধ সরিয়ে ফেলতে পারলেই দেখবেন আত্মবিশ্বাস হু হু করে বেড়ে গিয়েছে , পাশাপাশি মুখের এবং সার্বিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটবে । তাই এর কারণ বুঝতে পারা, সঠিক মুখের পরিচ্ছন্নতার রুটিন অবলম্বন করা, এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া সবই মিলে আপনার নিঃশ্বাসের মান বদলে দিতে পারে, এমনকি আপনার জীবনকেও পাল্টে দিতে পারে।
মনে রাখতে হবে মুখের দুর্গন্ধকে অবজ্ঞা না করে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়াটা শুধুই সতেজ নিঃশ্বাস পাওয়া নয়, একটা সুস্থ, আত্মবিশ্বাসী জীবনযাপনের অঙ্গ। আর এই যাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, অন্যদের সাথে যোগাযোগের পথ সুগম করে তুলতে পারে, এবং জীবনে আনতে পারে এক মিষ্টি প্রশান্তি।