বিট বা বিটরুট – গাঢ় লাল রঙের এই সবজিটিকে অনেকেই অপছন্দের তালিকায় রাখেন । কিন্তু এর পুষ্টিগুণ আর উপকারিতা জানলে সহজেই বোঝা যাবে কেন একে সুপারফুড বলে ডাকা হয়। সেকারনেই কাঁচা সব্জির পাশাপাশি এই বিট শুকিয়ে গুঁড়ো করে সারা বছরে খাওয়ার মত করে প্যাকেটজাত করে সারা বিশ্বে ব্যপক ভাবে বিক্রি হচ্ছে । পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে এই বিট শুকিয়ে গুঁড়ো করে বিদেশে পাঠাচ্ছে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান । বিটের জনপ্রিয়তা হঠাত বৃদ্ধির কারণ হল বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা , যেখানে তুলে ধরা হয়েছে এই সুপারফুডের আশ্চর্য উপকারিতা ।
পুষ্টিগুণের আধার বিটরুট:
বিটরুটে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং আরও নানান উপকারী উপাদান।
ভিটামিন :
- ভিটামিন সি (Vitamin C): বিটরুটে থাকা ভিটামিন সি শুধু একটা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নয়, এটি ত্বককে উজ্জ্বল করে, ত্বকের কোলাজেন তৈরি করে বলিরেখা দূর করে, এমনকি ক্ষত সারাতেও সাহায্য করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এর ভূমিকা অপরিসীম।
- ভিটামিন বি৬ (Vitamin B6): মস্তিষ্ক সুস্থভাবে কাজ করতে এবং নতুন কোষ তৈরি করতে ভিটামিন বি৬ অপরিহার্য। এটি স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে এবং শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
খনিজ :
- পটাশিয়াম (Potassium): পটাশিয়াম হচ্ছে এক অতি প্রয়োজনীয় খনিজ, যা শরীরের জল ও ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা করে, স্নায়ুর সুস্থতা নিশ্চিত করে এবং পেশির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে এর ভূমিকা অপরিসীম।
- ম্যাঙ্গানিজ (Manganese): এই খনিজ উপাদানটি হাড়কে শক্তিশালী করে, রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও ম্যাঙ্গানিজ একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা কোষের ক্ষতি রোধ করে।
- আয়রন (Iron): শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য আয়রন অপরিহার্য। হিমোগ্লোবিন শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পরিবহন করে। পর্যাপ্ত আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট:
- বিটালেইন (Betalains): এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শুধুমাত্র বিটরুটেই পাওয়া যায়। এর শক্তিশালী প্রদাহরোধী এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণাবলী শরীরের কোষগুলোকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমায়।
- আলফা লাইপোইক অ্যাসিড (Alpha-Lipoic Acid): এটি আরেকটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরের অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
ফাইবার:
- ডায়েটরি ফাইবার (Dietary Fiber): বিটরুটে প্রচুর পরিমাণে দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় আঁশ থাকে। এটি হজমে সাহায্য করে, কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
নাইট্রেট:
- প্রাকৃতিক নাইট্রেট (Natural Nitrates): বিটরুটে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক নাইট্রেট পাওয়া যায়, যা শরীরে নাইট্রিক অক্সাইডে রূপান্তরিত হয়। এই নাইট্রিক অক্সাইড রক্তনালীকে প্রশস্ত করে, রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং রক্তচাপ কমায়। এছাড়াও নাইট্রিক অক্সাইড শরীরের কর্মক্ষমতা বাড়ায় এবং শারীরিক পরিশ্রমের সময় অক্সিজেনের ব্যবহার দক্ষ করে তোলে।
বিটরুটের উপকারিতা:
হার্টের স্বাস্থ্য:
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: বিটরুটে থাকা নাইট্রেট রক্তনালীকে শিথিল করে রক্তচাপ কমায়, যা উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- রক্ত সঞ্চালন উন্নতি: নাইট্রিক অক্সাইডের কারণে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়, যা হৃদপিণ্ডের সার্বিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এনার্জি বুস্টার :
- সহনশীলতা ও শক্তি বৃদ্ধি: বিটরুটের রস ক্রীড়াবিদদের জন্য খুবই উপকারী কারণ এটি শরীরের শক্তি ও সহনশীলতা বাড়ায়।
- ক্লান্তি দূর করে: বিটরুট অক্সিজেনের ব্যবহার দক্ষ করে তোলে, যার ফলে ক্লান্তি আসতে দেরি হয় এবং দীর্ঘক্ষণ অনুশীলন করা সম্ভব হয়।
হজমের সমস্যা দূরীকরণ:
- হজমে সহায়তা: বিটরুটে থাকা ফাইবার হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- পেটের সমস্যা প্রতিরোধ: নিয়মিত বিটরুট খেলে কোলাইটিস, ডাইভার্টিকুলাইটিস এবং ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS) এর মতো সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি:
- সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই: শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে বিটরুট সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং রোগের সময়কাল কমাতে সাহায্য করে। শরীরকে যেন এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলে।
প্রদাহ কমায়, শরীর পরিষ্কার করে:
- প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই: বিটালেইনের প্রদাহরোধী গুণাবলী গাঁটের বাত, প্রদাহজনিত অন্ত্রের রোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। শরীরের ভেতরের অদৃশ্য আগুন নেভাতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
- লিভারের সুরক্ষা: লিভারকে ‘শরীরের পরিশোধন কেন্দ্র’ বলা হয়। বিটরুট লিভারের কার্যক্রমকে সচল রাখতে সাহায্য করে। বিটেইন নামক উপাদানটি লিভারকে সুরক্ষা দেয় এবং পুনরুজ্জীবিত করে, যা শরীরের বিষাক্ত পদার্থ নিষ্কাশন করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
মস্তিষ্কের বিকাশে :
- মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি: নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়, যা মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং সামগ্রিকভাবে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। চিন্তাশক্তিকে করে তোলে আরও প্রখর।
- স্নায়ুতন্ত্রের সুরক্ষা : বিটরুটে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো বার্ধক্যজনিত রোগ যেমন অ্যালঝেইমার্সের মতো সমস্যা থেকে মস্তিষ্ককে রক্ষা করতে পারে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক:
- কম ক্যালোরি, বেশি পুষ্টি: বিটরুটে ক্যালোরির পরিমাণ খুবই কম, কিন্তু পুষ্টিগুণে ভরপুর। এটি আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করে এবং খাবারের প্রতি চাহিদা কমায় ।
- বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ: ম্যাঙ্গানিজ এবং ভিটামিন বি৬ এর মতো পুষ্টি উপাদানগুলো বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, যা খাবারকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে এবং চর্বি জমতে বাধা দেয়।
বিটরুটের এই বিস্ময়কর পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারিতা সত্যিকার অর্থেই একটি সুপারফুডে পরিণত করেছে। হার্টের স্বাস্থ্য, ক্রীড়াবিদদের শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে, হজম, রোগ প্রতিরোধ এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পর্যন্ত, বিটরুট স্বাস্থ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই উপকারী ভূমিকা পালন করে।