গরমের দাবদাহে ‘পোড়া আমের শরবত’গরমের চড়া রোদে শুধু যে তেষ্টাই মেটায় তাই না, শরীরে আসে একটা প্রাণের সঞ্চারও। আর সেই তালিকায় দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা এক অপূর্ব পানীয় হলো ‘পোড়া আমের শরবত’। শুধু এই মরশুমি ফলের শরবত না, এর সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির সংস্কৃতির গভীরতা আর স্বাস্থ্যের অনেক উপকারিতা।
পোড়া আমের শরবত বানানোর সহজ পদ্ধতি
এই সুস্বাদু শরবতের যাত্রা শুরু হয় পাকা আম বেছে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে। মূল কৌশলটা লুকিয়ে আছে আমটাকে সরাসরি আগুনে পুড়িয়ে নেওয়ার মাঝে। এতে আমের গন্ধটা বেড়ে যায় কয়েকগুণ আর একটা ধোঁয়াটে ভাব আসে, যা সাধারণ আমের শরবত থেকে একেবারেই আলাদা করে দেয়। একবার বাইরের খোসাটা বেশ কালচে হয়ে এলে আর ভেতরের আম নরম হয়ে গেলে, খোসা ছাড়িয়ে শাঁসটা বের করে নেওয়া হয়।
এই শাঁস অনেকে হাতে করে মেখে নেন, আবার কেউ কেউ ঐতিহ্য রক্ষা করতে ‘শিল-পাটা’ ব্যবহার করে থাকেন। এরপর ঠাণ্ডা জলের সাথে মিশিয়ে শরবতের মূল ভিত্তি তৈরি হয়। জল কতটা দেওয়া হবে সেটা সম্পূর্ণ নিজের পছন্দের উপর নির্ভর করে – কেউ পছন্দ করেন ঘন, কেউবা আবার একটু পাতলা।
যে উপকরণগুলো এতে যোগ করে এক অন্য মাত্রা
এই আমের মণ্ডের সাথে যোগ হয় নানান উপকরণ – মিষ্টির জন্য চিনি বা গুড়, মিষ্টির ভারসাম্য রাখতে এক চিমটি নুন। ঝাঁঝ বাড়ানোর জন্য দেওয়া হয় ভাজা জিরের গুঁড়ো, আর কয়েকটা পুদিনা পাতা যোগ করে একটা মিষ্টি-ঠাণ্ডা সুবাসের জন্য। শুধু স্বাদ বাড়ানোই নয়, এই উপকরণগুলো পুষ্টির জোগানও দেয়।
স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী
পোড়া আমের শরবতের স্বাস্থ্যগুণের তালিকা বেশ লম্বা। প্রথমত, এই গরমে শরীরের যে জলশূন্যতা হয়, সেটা পূরণ করতে এর জুড়ি মেলা ভার। আমে প্রচুর ভিটামিন থাকে, বিশেষ করে ভিটামিন ‘এ’, যা চোখ এবং ত্বক ভালো রাখে। আবার ভিটামিন ‘সি’ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় আর শরীরে আয়রনের পরিমাণ বাড়ায়।
আমে থাকা ফাইবার হজমের জন্য উপকারী, কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। তাছাড়া, ক্যাফেইন বা চা-কফির মতো কিছুর সাহায্য ছাড়াই এনার্জি বাড়াতে পোড়া আমের শরবত বেশ কার্যকরী এক প্রাকৃতিক উপায়।
শুধু যে স্বাস্থ্যের কথাই ভাববেন তা না, পোড়া আমের শরবত একটা সাংস্কৃতিক প্রতীকও বটে। এটা কোনো পানীয় নয়, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসা একটা রীতি, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যেখানে আমের ছড়াছড়ি। এই শরবত বানানো অনেক সময় পরিবার বা পাড়ার সবার একসাথে মিলেমিশে করার একটা উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।
শহরেও এই পানীয়র কদর কম না। রান্নার উৎসব বা নানান মেলায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের সাথে যোগসূত্র হিসেবে পোড়া আমের শরবতের ব্যাপক চাহিদা থাকে। অনেকে মাটির ভাঁড়ে এই শরবত পরিবেশন করেন, সেটা স্বাদেও একটা মাটি মাটি ভাব নিয়ে আসে, আবার তাপমাত্রাও ঠাণ্ডা রাখে। আর লোকাল ট্রেনের কথা তো না’ই বললাম, গরমে লোকাল ট্রেনে আম পোড়া আমের শরবত ছাড়া একটা দিনও কারো গুজরান হয় না ।
পোড়া আমের শরবত গরমের তৃষ্ণা মেটানোর থেকেও অনেক বেশি কিছু। সাধারণ উপকরণকে অসাধারণ করে তোলার ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন এটা, স্বাদ আর স্বাস্থ্যের অপূর্ব মেলবন্ধন। সারা পৃথিবী যখন স্থায়ী এবং অরগানিক খাদ্যের দিকে ঝুঁকছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রাচীন পানীয় এক উত্তরাধিকারের প্রতীক তো বটেই, পুষ্টির জ্ঞানভাণ্ডার হিসেবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। ফুটপাতের দোকান হোক আর বাড়ির আরাম, পোড়া আমের শরবত হয়ে ওঠে গরমের দিনে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস!