পর্তুগীজরা এদেশে আলু নিয়ে আসার পর থেকে বাঙালি তাকে এত আপন করে নিয়েছে যে আজ আলু ছাড়া একটা দিন ভাবাই দুঃসাধ্য ব্যাপার । তবে আলু যে কেবলমাত্র বাঙালীর প্রিয় খাবার এমনটা নয় । সারা পৃথিবী জুড়েই আলু অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার হিসাবে সমাদৃত ।
খাবারের জগতে আলুর ব্যবহার যেমন ব্যাপক, ঠিক তেমনই ব্যাপক হচ্ছে আলু আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে তা নিয়ে গবেষণা। আলুর সব থেকে বড় দুর্নাম হল টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) নিয়ে । গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) হল কোনো খাবার খাওয়ার পর রক্তে শর্করার মাত্রা কত দ্রুত বৃদ্ধি পায় তা পরিমাপের একক ।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখা যাচ্ছে যে আলুকে কীভাবে রান্না করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে এর স্বাস্থ্যের উপর তা কী প্রভাব ফেলবে । উদাহরণস্বরূপ, পোড়ানো বা সেদ্ধ আলুতে এর পুষ্টিগুণের কোনো পরিবর্তন হয়না এবং সারা পৃথিবীর অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবারে সেদ্ধ আলু ব্যবহৃত হয় এক্ষেত্রে কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কম থাকে। অন্যদিকে, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা চিপস হিসেবে তৈরি আলুতে অনেক অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও লবণ থাকে এবং এই পদ্ধতিতে রান্নার কারণে এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) অনেক বেশি থাকে, ফলে ডায়াবেটিসের জন্য এগুলো থেকে অনেক বেশি বিপদের সম্ভাবনা থাকে । তবে আলু সেদ্ধ করার পরিবর্তে বেক করা বা গ্রিল করা আরও ভালো আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস বা চিপস এগুলো নিশ্চিত ভাবে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে ।
হার্ভার্ড স্কুল অফ পাবলিক হেলথের মতো জায়গায় যেসব গভীর গবেষণা করা হয়েছে, সেগুলো থেকে আরও বিস্তারিত ছবি পাওয়া যায়। যেখানে বেশি পরিমাণে আলু খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে বলে তথ্য পাওয়া গেলেও সেই তথ্যের ভেতরে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে । যেমন, নার্সেস হেলথ স্টাডি এবং হেলথ প্রফেশনালস ফলো-আপ স্টাডি-তে বোঝা যায় যে একটি সুষম খাদ্যাভ্যাসের (ব্যালেন্সড ডায়েট) মধ্যে ভাজা নয় এমন আলু খেলে ততটা ঝুঁকি থাকে না, যতটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর মতো রূপে খেলে থাকে ।
আন্তর্জাতিক খাদ্যাভ্যাসের ধরনে এর বিপরীত চিত্র আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়। ইরানে সেদ্ধ আলু খাবারের একটি সাধারণ উপাদান, অথচ সেখানে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এর কারণ হিসাবে বলা হয় সেখানকার সামগ্রিক খাদ্যাভ্যাসের কথা – অনেক রকমের ফল, শাকসবজি, দানা শস্য, এবং বিনসের সাথে সেদ্ধ আলুও সেখানকার ডায়েটের একটি অংশ। সুতরাং কোনো একটি খাবারকে আলাদা করে না দেখে সবগুলো খাবারের যোগফলটা কেমন গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) বাড়াচ্ছে তা দেখা উচিত ।
যারা ডায়াবেটিস নিয়ে চিন্তা করছেন তাঁদের জন্য মূল কথাটা হল আলুকে স্বাস্থ্যকর ডায়েটে রাখা যেতেই পারে, যদি তাকে সঠিক পদ্ধতিতে রান্না করা যায়।আলু পোড়া , আলু সেদ্ধ বা বেক করে খেলে এবং নানা ধরনের উদ্ভিদজাত খাবারের সমৃদ্ধ একটি ডায়েটের মধ্যে রাখলে এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) এর মান কমিয়ে আনা সম্ভব । সেইসাথে আলুকে নানা রকমের স্বাস্থ্যকর ভাবে রান্না করে খেতে পারলে এই রোজকার এই সবজিটিকে ডায়েটে চিন্তার বিষয় না বানিয়ে বরং ডায়েটের উপকারী অংশ করে তোলা যেতে পারে।
তাই আলু খেতে হলে যে পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করা উচিৎ –
- প্রক্রিয়াজাতকরণ এড়িয়ে চলুন: আলু খেতে হলে আলু পোড়া , সেদ্ধ , বেক করে কিংবা গ্রিল করে খাওয়া ভালো । ভাজা আলু যেমন ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস বা চিপস এড়িয়ে চলা উত্তম।
- খোসা সহ খান: আলুর খোসায় ফাইবার থাকে যা শর্করার শোষণ কমায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে সাহায্য করে।
- অন্যান্য খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে খান: আলুর সাথে প্রোটিন বা ফাইবার যুক্ত খাদ্য যেমন মাংস, মাছ, সবজি বা ডাল খাওয়া ভালো। এতে করে গ্লাইসেমিক প্রভাব কমে যায়।
- পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন: আলুর পরিমাণ সীমিত রাখুন। অতিরিক্ত পরিমাণে আলু খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
- আলু ঠান্ডা করে খান: আলুকে ঠান্ডা করে পরিবেশন করলে GI মান কমে যায়, কারণ ঠান্ডা করার ফলে আলুর রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চের পরিমাণ বাড়ে (GrowPerfect) যা পরবর্তীতে গ্লাইসেমিক প্রতিক্রিয়াকে হ্রাস করে।
তবে এর পাশাপাশি বিভিন্ন আলুর প্রজাতির উপরেও গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্সের পরিমাণ বিভিন্ন রকমের হতে পারে যেমন জ্যোতি আলুর তুলনায় দেশী লাল আলুর আবার GI কম আবার দেশী লাল আলুর থেকে আরও কম গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স হল দার্জিলিঙের পাহাড়ি আলুর । তাই কোন আলু খাচ্ছেন সে দিকেও খেয়াল রাখা জরুরী ।