পৃথিবীর বুকে এমন এক জায়গা আছে, যেখানকার তাপমাত্রা এতই বেশি যে মনে হতে পারে সূর্য নিজেই এসে মাটি ছুঁয়েছে। ইরানে অবস্থিত এই বিশাল, রুক্ষ অঞ্চল হল লুত মরুভূমি, বা দাশত-ই-লুত । পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান হিসেবে এর আলাদাই খ্যাতি রয়েছে। মরুভূমির বিস্তীর্ণ বালির ঢেউ আর পাথুরে ভূমির মাঝে এখানকার তাপমাত্রা যে হারে বাড়ে, তা যে কোনো প্রাণের অস্তিত্বকেই যেন চ্যালেঞ্জ জানায়।
লুত মরুভূমির এই ‘সবচেয়ে গরম’ তকমা স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে। এখানকার ভূমির তাপমাত্রা ৭০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসকেও ছাড়িয়ে যায়। এই ভয়ংকর গরম শুধু এক-আধবারের ব্যতিক্রম নয়, গ্রীষ্মের দাবদাহের সময় এখানে নিয়মিতই দেখা যায়। তাই, বৈজ্ঞানিকদের কাছে লুত মরুভূমি একটা বিশেষ আকর্ষণের জায়গা, আর দুঃসাহসী ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক রোমাঞ্চকর গন্তব্য।
প্রায় ৫১,৮০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে লুত মরুভূমি বিস্তৃত — যেখানে শুধু বালি, লবণ আর পাথরের মেলা। এটি আবার তিনটি ভাগে বিভক্ত: উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ লুত । প্রত্যেকটি অংশের রয়েছে নিজস্ব ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। উত্তর লুত বিখ্যাত বিশাল বিশাল বালিয়াড়ির জন্য, যেগুলোর উচ্চতা প্রায় ৪৮০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। লুটের মধ্যাংশে দেখা মেলে ‘ইয়ারডাং’ এর – এগুলো মূলত বহু বছরের বাতাসের ক্ষয়ের ফলে অদ্ভুত আকৃতি নেওয়া পাথুরে ঢিবি। আর দক্ষিণ লুটে বিস্তৃত লবণাক্ত সমতল ভূমি, যেখানে প্রখর রোদের আলোয় মাটি ঝিকমিক করে ওঠে, যেন বরফের চাদর পড়ে আছে।
লুত মরুভূমিকে প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, এ যেন একেবারে প্রাণহীন এক জায়গা। কিন্তু, এই উত্তাপের কেন্দ্রেই প্রাণ তার অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতার প্রমাণ রাখে। মরুভূমের কঠিন পরিবেশেও কিছু কিছু উদ্ভিদ ও প্রাণী টিকে থাকার পথ বের করে নিয়েছে। মরুভূমের শিয়াল, টিকটিকি এরা ভয়ঙ্কর তাপমাত্রা, জলের তীব্র অভাব – সবকিছু সামলে বেঁচে থাকার এক অসামান্য দৃষ্টান্ত। এদের উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে জীবনের অদম্য ইচ্ছা যেকোনো প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারে।
বৈজ্ঞানিক এবং দুঃসাহসী ভ্রমণকারী – দুই পক্ষের কাছেই লুত মরুভূমি এক উৎসাহের জায়গা। গবেষকরা এই চরম আবহাওয়ার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পৃথিবীতে প্রাণের সীমা পর্যবেক্ষণ করেন। ভ্রমণপিপাসুরা পৃথিবীর অন্যতম দুর্গম পরিবেশকে জয় করার রোমাঞ্চ খোঁজেন। এছাড়া, নাসা এবং অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থা লুত মরুভূমিকে অন্য গ্রহের অনুকরণ হিসেবে ব্যবহার করে; বিশেষ করে মঙ্গল গ্রহের পরিবেশ নিয়ে গবেষণার জন্য এই মরুভূমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়।
মরুভূমির বালির ঢেউ আর পাথুরে ভূমির এই বিস্তার শুধুই প্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে প্রাচীন লোককথা, আর দৈত্য-জ্বিনদের গল্প, । লুত মরুভূমির পিছনের মিথ তাই বালিয়াড়ি আর পাথরের মতোই রহস্যময়, যে আমাদেরকে নিয়ে যায় এক অন্য জগতে।
পারস্যের পুরাণে মরুভূমিকে বরাবরই এক কঠিন পরীক্ষার স্থান হিসেবে দেখা হয়। এই সীমাহীন মরুরাজ্য নাকি জ্বিনদেরই অধিকারে, যারা তৈরি আগুন আর ধোঁয়া থেকে। লুত মরুভূমির প্রচণ্ড গরম তাই জ্বিনদের মেজাজেরই প্রতিফলন। লোককথা বলে, বালির নিচে ওদের অদৃশ্য নগরী আছে, তারাই মরীচিকার ছলনায় পথিকদের বিভ্রান্ত করে। লুত পেরোনো ভ্রমণকারীরা দেখেছেন আকাশে রাতের বেলা আগুনের নাচ, সেটাই নাকি ওই জ্বিনদেরই তাণ্ডব!
আরেক পুরাণকথা আছে লুত মরুভূমি নিয়ে। প্রাচীন পারস্য ধর্মে ‘হওয়ার খশাইতা’ হলেন সূর্যদেবতা। লুত মরুভূমিই নাকি তার কর্মশালা, যেখানে তিনি রাতের অন্ধকারকে ছিন্ন করে দিনের আলো গড়ে নেন। মরুভূমির নিষ্ঠুর তাপকে তাই হ্ওয়ার খ্শাইতার শক্তির প্রকাশ হিসেবে দেখা হতো। মরুভূমির বালিরা সূর্যের আলোয় বদলাতে থাকে ঠিক যেন সূর্যদেবতা নিজেই মাটির বুকে হাত বোলাচ্ছেন।
লুত মরুভূমির কাহিনীর মধ্যে আছে অসম্ভব রকমের বড়ো বড়ো সাপের গল্পও। এরা নাকি মরুভূমির পাহারাদার, বালির নিচে লুকিয়ে থাকা প্রাচীন ধন-রত্নের রক্ষক। ওদের জ্ঞান নাকি সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হল জহাক, এক ড্রাগনের মতো সাপ, যে লুতের ভাগ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে। কথিত আছে, জহাকের নিঃশ্বাসেই লুটে প্রচণ্ড গরম বাতাস বয়, মাটির নিচে তার নড়াচড়া থেকেই নাকি তৈরি হয়েছে মরুভূমির বালির ঢিবি আর পাথরের খাড়া ঢাল। আজও অনেক স্থানীয় লোক জহাকের কথা ভয় এবং সমীহ মিশিয়ে বলে, যেন সেই প্রাচীন সাপ এখনও বালির নিচে লুকিয়ে আছে, রাজত্ব সামলাচ্ছে।
লুত মরুভূমির বুকে নাকি লুকিয়ে আছে এক অলৌকিক মরূদ্যান – যেখানে আছে চিরঞ্জীবনের ঝর্ণা। কেউ যদি মরুভূমির কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এই মরূদ্যান খুঁজে পায়, তাকে নাকি শুধু অমরত্বই দেওয়া হয় না, সাথে মেলে মরুভূমির গভীর, প্রাচীন জ্ঞান। তবে এই জায়গা সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে লুকিয়ে আছে। মরুভূমির আত্মা সেই মরূদ্যান শুধু তাদেরই দেখায়, যারা বিশুদ্ধ চিত্ত এবং অসীম সাহসী। মরুভূমির নিষ্ঠুর গরমে যেন সেই মরূদ্যান এক মরীচিকার মতোই মিলিয়ে যায়।
লুত মরুভূমি শুধু পৃথিবীর উষ্ণতম স্থান নয়, এটি এক অপূর্ব প্রাকৃতিক বিস্ময়; পৃথিবীর বৈচিত্র্য এবং প্রাণের অদম্য জেদের এক নিদর্শন। এর ভূমিরূপ আমাদের মনে বিস্ময় এবং শ্রদ্ধার জন্ম দেয়, আমাদেরকে প্রকৃতির শক্তি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়। যারা জগতের চরম রূপগুলোর রহস্য উন্মোচন করতে চায়, তাদের কাছে লুত মরুভূমি এক উদ্দীপনার উৎস, অনন্ত অনুপ্রেরণার আধার।