মহাকাশ, মানুষের odyssey অভিযানের পরবর্তী গন্তব্য। কিন্তু মহাকাশের রহস্যময় পরিবেশ বিশেষত মহাকর্ষের অনুপস্থিতি, মানবদেহের ওপর কী প্রভাব ফেলে তা এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। এই রহস্যের জট খুলতে বিজ্ঞানীরা নানা প্রাণীর সাহায্য নিচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম হল ছোট্ট মাছ জেব্রাফিশ। সম্প্রতি চীনের মহাকাশ স্টেশন তিয়ানগং-এ জেব্রাফিশের ভ্রূণ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেন এই ছোট্ট মাছটি মহাকাশ গবেষণায় এত গুরুত্বপূর্ণ, এর ইতিহাস কী এবং ভবিষ্যতে মহাকাশ অভিযানে এর ভূমিকা কী হতে পারে তা নিয়ে জানা যাক ।
জেব্রাফিশ: মহাকাশের মডেল জীব
জেব্রাফিশকে বলা হয় মডেল জীব, কারণ এর জিনের গঠন ও শারীরিক গঠন অনেকটা মানুষের মতো। মানুষের শরীরে যেমন হৃৎপিণ্ড, লিভার, কিডনি ইত্যাদি অঙ্গ রয়েছে, জেব্রাফিশের শরীরেও প্রায় একই রকম অঙ্গ রয়েছে। তাই মানুষের উপর যেসব পরীক্ষা করা সম্ভব নয় বা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়, সেগুলো জেব্রাফিশের উপর করে মানুষের শরীর সম্পর্কে জানা যায়।
জেব্রাফিশের ভ্রূণ স্বচ্ছ হয়, তাই ভ্রূণের বিকাশের প্রতিটি ধাপ সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায়। এছাড়া জেব্রাফিশের জীবনচক্র খুব ছোট, তাই অল্প সময়েই বংশ পরম্পরায় এর বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা যায়। এই সুবিধাগুলোর কারণেই মহাকর্ষহীন পরিবেশে জীবদেহের উপর গবেষণার জন্য জেব্রাফিশ আদর্শ।
মহাকাশ গবেষণায় মাছ
জেব্রাফিশের মহাকাশ যাত্রা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ১৯৭৩ সালে স্কাইল্যাব ৩ মিশনে প্রথমবারের মতো মহাকাশে দুটি মামিচগ মাছ পাঠানো হয়েছিল। পৃথিবীর মহাকর্ষ না থাকায় মাছগুলো প্রথম তিন সপ্তাহ সাঁতার কাটতে পারেনি। তবে এটা দেখাগিয়েছিলো যে , মানুষের মতো মাছেরও মহাকর্ষহীন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সময় লাগে। এরপর থেকে মহাকাশে মাছ নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে।
১৯৭০-এর দশকে রাশিয়ার স্যালুত ৫ মহাকাশ স্টেশনেও জেব্রাফিশ নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) জেব্রাফিশকে নিয়ে মহাকর্ষহীনতায় পেশীর ক্ষয় নিয়ে গবেষণা হয়। এছাড়াও জেলিফিশ, গোল্ডফিশ, গাপ্পি, স্যালামান্ডার, টোডফিশ ইত্যাদি নিয়েও মহাকাশে গবেষণা চলেছে। এই সমস্ত গবেষণার লক্ষ্য ছিল মহাকর্ষের অনুপস্থিতি কীভাবে ভারসাম্য, স্থানিক সচেতনতা এবং প্রজনন আচরণকে প্রভাবিত করে তা বোঝা।
তবে জেব্রাফিশ শুধু মহাকাশেই নয়, পৃথিবীতেও চিকিৎসা গবেষণায় বিরাট অবদান রেখেছে। ভ্রূণের বিকাশ, সংক্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং জেনেটিক রোগ নিয়ে গবেষণায় জেব্রাফিশ মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মহাকর্ষহীন পরিবেশে হাড়ের ক্ষয়, পেশির ক্ষয়, হৃৎপিণ্ডের সমস্যা, এমনকি ডিএনএ-র ক্ষতি নিয়ে গবেষণায় জেব্রাফিশ ব্যবহার করা হয়েছে। এই গবেষণাগুলোর ফলাফল মহাকাশে দীর্ঘদিন থাকার সময় মহাকাশচারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে জানতে এবং প্রতিরোধের উপায় বের করতে সাহায্য করেছে।
মহাকাশে মাছ নিয়ে গবেষণা শুধু মাছের ব্যাপার নয়, এটা আসলে মানুষের ব্যাপার। মহাকর্ষহীন পরিবেশে মানবদেহ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা বুঝতে এই গবেষণাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গল বা অন্য কোনো গ্রহে মানুষের দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের জন্য এই গবেষণাগুলোর ফলাফল অত্যন্ত দরকারি ।