ইতিহাস আর পুরাকাহিনীর আলিঙ্গনে লুকিয়ে আছে চন্দ্রকেতুগড়। প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসেবে এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলটি ভারতের বহুবিধ ঐতিহ্যের মধ্যেই যেন হারিয়ে গেছে, কিন্তু এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এটি । বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়, বিদ্যাধরী নদীর ধারে, ‘বেঁড়াচাঁপা’ নামে পরিচিত চন্দ্রকেতুগড় একসময়ে ছিল বাণিজ্য এবং সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
প্রাচীন মহানগর: সভ্যতার নিদর্শন
চন্দ্রকেতুগড়ের ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত, সময়ের সাথে সাথে তা গুপ্তযুগ (তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী) এবং সম্ভবত পাল রাজবংশ (অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী) পর্যন্ত চলে এসেছে। গাঙ্গেয় উপত্যকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে বিস্তৃত বাণিজ্যপথের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কারণে চন্দ্রকেতুগড় ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
চন্দ্রকেতুগড়ের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে নানান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যেগুলোর মধ্যে আছে জটিল নকশা করা টেরাকোটার ফলক, মৃৎপাত্র, মূল্যবান পাথরের জপমালা, মুদ্রা বা প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ। এই নিদর্শনগুলোর নির্মাণশৈলী থেকে বোঝা যায় তৎকালীন সমাজে বাণিজ্য, শিল্পকলা, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনযাত্রা কতটা উন্নত ছিল।
টেরাকোটা: দৈনন্দিন ও ধর্মীয় জীবনের নিদর্শন
চন্দ্রকেতুগড়ের অন্যতম আকর্ষণ হলো টেরাকোটা শিল্প। এই মাটির ফলকগুলিতে ফুটে উঠেছে এখানকার দৈনন্দিন জীবনের নানান দৃশ্য, পৌরাণিক কাহিনী, আর তৎকালীন উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের এক বিচিত্র চিত্র। টেরাকোটার এই শিল্পকর্ম সেই সময়কার রুচিবোধের সাথে সাথে ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কেও একটা ধারণা দেয়।
রহস্যময় পতন
এককালে এই সমৃদ্ধশালী নগর কেন ধীরে ধীরে পতনের মুখে এলো? ইতিহাসবিদ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদরা এ নিয়ে নানা মতামত দিয়েছেন। কারও মতে বাণিজ্যপথের পরিবর্তন, কারও মতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আবার কেউ বলেন বহিরাগত আক্রমণের কারণে চন্দ্রকেতুগড় জনশূন্য হয়ে পড়ে।
চন্দ্রকেতুগড়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সত্ত্বেও এ নিয়ে সরকার তেমন মাথা ঘামাইয়নি । সীমিত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, লুঠপাট আর অবৈধ দখলদারির কারণে এই প্রাচীন স্থানটির অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। স্থানীয় প্রশাসন, ইতিহাসবিদরা চন্দ্রকেতুগড়কে রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই চান ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাক এই স্থান। তাহলেই সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া সহজ হবে।
বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে চন্দ্রকেতুগড় বা বেড়াচাঁপা । এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি অতীতের সাথে আমাদের যোগসূত্র, যেখানে বাণিজ্য, শিল্পকলা, এবং আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ছাপ স্পষ্ট। আশা করা যায় চন্দ্রকেতুগড়কে রক্ষার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুপম নিদর্শন হিসেবে এই স্থানটি আবার তার স্বীকৃতি পাবে।